হাওরে পুরুষের পাশাপাশি শ্রম দিচ্ছেন নারীরাও
সকাল থেকেই ধূসর রঙের মেঘ ভাসছিল আকাশে। হাওরের পথে যেতে দু-চার ফোঁটা বৃষ্টিও ঝরেছে। হঠাৎ ঝলমলে রোদ বুকে নিয়ে হেসে ওঠে নীল আকাশ। বেলা বাড়লে বৈশাখের তপ্ত রোদে ঘামে ভিজে ওঠে শরীর। একসময় মনে হয়, চামড়া পুড়ে যাচ্ছে। তবে কৃষক পরিবারের সদস্যদের কারও চোখেমুখে ক্লান্তি নেই, আছে কেবল তৃপ্তির রেশ। তাঁরা জানান, এবার বেশ ভালো ফলন হয়েছে হাওর এলাকায়। ঝড়বৃষ্টি না থাকায় ঝামেলা ছাড়াই এসব ফসল ঘরে তোলার আয়োজন চলছে এখন।
গত রোববার সকালের ওই গরমে মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপারের কাদিপুর এলাকায় ধান শুকানোর কাজ করছিলেন ময়না রানী সরকার। তিনি বলেন, ‘দিন খুব ভালা। ঝড়বিষ্টি নাই।’
কাউয়াদীঘি হাওরপারের কাদিপুর এলাকাটি তুলনামূলকভাবে নিচু। সেখানে তৈরি করা হয়েছে ধানের খোলা। এই খোলায় ধানমাড়াই, ঝাড়াই, সেদ্ধ থেকে শুকানো সবই করা হয়। পাশাপাশি খড়ও শুকানো হয় সেখানে। এসব কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন হাওর এলাকার কৃষক পরিবারগুলোর নারী সদস্যরা। দিনের বেশির ভাগ সময় তাঁদের এসব কাজেই ব্যয় হচ্ছে। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কাদিপুর, রাজনগর উপজেলার অন্তেহরিসহ কাউয়াদীঘি হাওরপারে এই সময়ে এমন ছোট–বড় অনেক খোলা দেখা যায়। গ্রাম বা লোকালয় থেকে কিছুটা দূরে এসব স্থানে ময়না রানীর মতো আরও অনেক নারী শ্রম দিচ্ছেন পুরুষদের পাশাপাশি।
কাউয়াদীঘি হাওরপারে দেখা যায়, পরিবারের পুরুষ সদস্যরা ধান কাটার পাশাপাশি আঁটি কাঁধে নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে নেওয়াসহ আরও অনেক কাজে ব্যস্ত। সমানতালে নারীরা ধানঝাড়াই, শুকানো, শুকনা ধান বস্তায় ভরা, কম শুকনা ধান স্তূপ করে রাখা, খড় শুকানো ও স্তূপ করার কাজ করছেন। কাজের ফাঁকে কেউ ধানের আঁটির স্তূপের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। পানি, পান-সুপারিসহ বিভিন্ন খাবার ভাগ-বাঁটোয়ারা করে খাচ্ছেন।
জবা রানী বিশ্বাস নামের এক নারী বলেন, ‘সকাল সাতটাত খোলায় আইছি (এসেছি)। কোন সময় যাইমু (যাব) ঠিক নাই। সারা দিন ধান ফালাই (শুকানোর জন্য ধান মেলে দেওয়া), উয়াই (ধানা ঝাড়া), মাড়া দেওয়াই (যন্ত্রে ধান মাড়াই), খের (খড়) শুকাই। বেটাইনতে (পুরুষ) ধান কাটইন (কাটেন)। কাউয়াদীঘি আওর (হাওর) থাকায় ভাত খাইতাম পাররাম। ২৫ বছর ধরি আমি ধান তুলি। রইদ (রোদ) দিলে ১৫ দিনে ধান তোলা যায়, নাইলে এক মাস লাগে।’
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামলে হাতের কাজ শেষ করে চুলায় ধান সেদ্ধ বসান সুকীর্তি রানী বিশ্বাস। খড় ঠেলে আগুন দিতেই দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুনের শিখা। বাতাসে ধোঁয়া ছড়িয়ে যায় চারদিকে। এর মধ্যেই বসে তিনি বলেন, ‘আমরা নারীরা এখানোই (হাওরের খোলা মাঠে) সবতা (সবকিছু) শেষ করি। না করলে অয় (হয়) না। বাড়িত রইদ কম মিলে। এখানো সকাল থাকি (থেকে) সন্ধ্যা পর্যন্ত রইদ থাকে।’
নিজে কষ্ট করে ঘরের ভাত খাওয়ার মধ্যে অন্য রকম আনন্দ আছে বলে মনে করেন ঝর্না রানী নাথ। তাঁর কথা শুনতে শুনতে সন্ধ্যা একেবারে ঘনিয়ে আসে। এ সময়ে একা একা ধান গোছাতে পারছিলেন না আরেক নারী। বুঝতে পেরে তাঁর দিকেই এগিয়ে যান ঝর্না। ওই নারীর সঙ্গে তিনিও কাজে হাত লাগান। দ্রুতই আধা শুকনা ধান স্তূপ করে পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখেন তাঁরা। ঝর্না জানালেন, তাঁরা একে অপরকে সব সময় সহযোগিতা করেন। একজনের বাড়ি থেকে কোনো খাবার এলে যতটুকু পারা যায়, ভাগাভাগি করে খান। তাঁরা তো কেউ পর নন, একই এলাকার মানুষ।