বাবার ঋণ আদায়ে তুলে নেওয়া হলো ছেলেকে, পরীক্ষা দিতে পারল না
রাজশাহীর চারঘাটে বাবার ঋণের জন্য ছেলেকে তুলে নিয়ে গেছেন ঋণের এক কারবারি। ওই ছেলের আজ রোববার কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে একটি ট্রেডের পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আজ তার পরীক্ষা দেওয়া হলো না।
ওই শিক্ষার্থীর বাড়ি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার মুংলী গ্রামে। তার বাবার নাম সেলিম হোসেন। ঋণগ্রস্ত হয়ে চলতি বছরের শুরুর দিকে সেলিম হোসেন সপরিবার আত্মগোপনে চলে যান। আত্মগোপনে থাকার কারণে তাঁর ছেলের এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। এরপর তাকে একটি কারিগরি বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়।
ঋণগ্রস্ত সেলিম হোসেনের ছেলের পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল রাজশাহী নগরের লোকনাথ উচ্চবিদ্যালয়ে। পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ওই শিক্ষার্থী রাজশাহী শহরে তার খালার বাড়িতে এসেছিল। ৬ নভেম্বর পরীক্ষা শুরু হয়েছে। আজ তার একটি ট্রেডের পরীক্ষা ছিল। এরই মধ্যে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় ছেলেটিকে রাজশাহী নগরের ভুবনমোহন পার্ক এলাকা থেকে আটক করা হয়। ফলে আজ সে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি।
ওই শিক্ষার্থীর এক আত্মীয় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ছেলেটিকে সোহান নামের এক ব্যক্তি আটক করে নিয়ে গেছেন। সোহানের বাড়ি চারঘাট উপজেলার ফরিদপুর এলাকায়। এ ঘটনায় রাজশাহী নগরের বোয়ালিয়া থানা ও চারঘাট থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার জন্য গিয়েছিলেন স্বজনেরা, কিন্তু পুলিশ নেয়নি।
এ বিষয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সোহান প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন, তিনি সেলিম হোসেনের ছেলেকে আটক করেছেন এবং তাঁর জিম্মায় তাকে রেখেছেন।
সোহান দাবি করেন, ছেলেটির বাবা সেলিম হোসেন তাঁর কাছ থেকে ১৪ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। এই টাকা তাঁর (সোহান) নিজের নয়, অন্য জায়গা থেকে ঋণ করে এনে দিয়েছিলেন। এ জন্য আরও ১৪ লাখ টাকা তাঁকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে।
এ–সংক্রান্ত সব প্রমাণপত্র রয়েছে জানিয়ে সোহান দাবি করেন, তিনি একা নন, এলাকার অনেক মানুষ সেলিম হোসেনের কাছে টাকা পাবেন। তাঁরা সবাই আসছেন। সেলিম হোসেন ও তাঁর আত্মীয়স্বজনদের আসার জন্য বলা হচ্ছে। কিন্তু তাঁরা কেউ এখন পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। সেলিম হোসেনের ছেলেকে তিনি যত্নসহকারে রেখেছেন। নিজে জেগে থেকে ছেলেটিকে ঘুম পাড়াচ্ছেন। ছেলেটির কোনো ক্ষতি হবে না।
তবে ছেলেটিকে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য একটু উদারতা দেখানো যেত কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সোহান বলেন, এটা তাঁর একার বিষয় নয়। সেলিম অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন।
বিষয়টি নিশ্চিত হতে সোহানের বাড়ি গিয়েছিলেন স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিক। সেখানে সোহানের ভাই পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি বলেন, ছেলেটি তাঁদের বাড়িতে নেই। তাঁদের মতো ৫০ জন সেলিমের কাছে টাকা পাবেন। তাঁদেরই কোনো একজনের বাড়িতে ছেলেটিকে রাখা হয়েছে। তাঁদের দাবি, পুলিশের সঙ্গে পরামর্শ করেই তাঁরা ছেলেটিকে দেখভাল করছেন। সমঝোতা হলে পুলিশের মাধ্যমেই হবে, থানায় বসা হবে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য চারঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমানের ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ধরেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চারঘাটের মুংলী গ্রামে সেলিম হোসেনের ইলেকট্রনিকস পণ্যের দোকান ছিল। ভালো ব্যবসা হচ্ছিল। কিছু জায়গাজমিও আছে। একতলা ছাদের বাড়ি। সচ্ছল পরিবার। তবে কিছু মানুষের কাছ থেকে ধার নিয়ে তিনি আর শোধ করতে পারছিলেন না। গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি গভীর রাতে তিনি সপরিবার বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। তিনি কোথায় আছেন, কেউ বলতে পারছেন না। গত এপ্রিলে তাঁর ছেলের এসএসসি পরীক্ষা ছিল। সেটাও দিতে পারেনি।
মুংলী বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সেলিম হোসেনের ইলেকট্রনিকসের দোকান ‘সেলিম স্টোর’ বন্ধ। বাজারের পেছনেই তাঁর বাড়ি। বাড়িতে তাঁর মা হোসনে আরা বেগমকে পাওয়া গেল। উঠানে বসে নাতির পোষা পাখিকে খাবার দিচ্ছিলেন। একা বাড়িতে আছেন, খাওয়াদাওয়া করছেন কীভাবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাশেই তাঁর মেয়ের বাড়ি। মেয়ের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করেন।
একপর্যায়ে কেঁদে ওঠেন হোসনে আরা। তিনি বলেন, ছেলে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর পাঁচ থেকে সাতজন টাকার জন্য এসেছেন। তাঁরা কেউ বলছেন, পাঁচ লাখ টাকা পাবেন, কেউ বলছেন আট লাখ টাকা পাবেন। ছেলে তাঁকে এসবের কিছু বলে যাননি। নাতিকে উদ্ধারের জন্য গিয়েছিলেন হোসনে আরা। কিন্তু দাদির জিম্মায় ছেলেটিকে ছাড়া হয়নি।