ক্ষীরসা, শাহী প্রভৃতি দইয়ে জমজমাট মেলা
মাঘ মাসের শীতের সকাল। গত কয়েক দিনের তুলনায় কুয়াশা কম। বিভিন্ন আকারের মাটির পাত্রে দই সাজানো। ক্রেতাদের ভিড়ে জমে উঠেছে দইমেলা। এ চিত্র সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার রশিক রায় মন্দিরের মাঠের (বর্তমানে ঈদগাহ মাঠ)। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সরস্বতীপূজা উপলক্ষে আজ সোমবার এ মেলার আয়োজন করা হয়।
প্রতিবছর মাঘ মাসের শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ঐতিহ্যবাহী দইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। দিনব্যাপী এই মেলায় তাড়াশসহ পাশের পাবনা, নাটোর ও বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলার দই প্রস্তুতকারকেরা আসেন।
স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে মেলায় দই কিনতে এসেছেন সঞ্জয় কুমার দাস। তাঁদের বাড়ি তাড়াশ উপজেলা সদরে। সঞ্জয় কুমার বলেন, ‘প্রতিবছরের মতো সরস্বতীপূজার দিনে ঐতিহ্য মেনে দই কিনতে এসেছি। এলাকার সব লোকজন মেলায় আসেন। ফলে মেলা জমজমাট হয়ে ওঠে।’
পুলক কুমার ঘোষ মেলায় এসেছেন ছোট মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। পুলক বলেন, নানা কারণে দইমেলার জৌলুশ কমেছে। তারপরও ঐতিহ্যের টানে সব ধর্মের মানুষই মেলায় আসেন।
উপজেলার সলঙ্গা বাজার এলাকার একটি শিশুশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান মোস্তফা জামান বলেন, ‘ব্যতিক্রমী এ মেলার কথা অনেক দিন ধরে শুনছি। এবার তাই দেখতে এসেছি। বিভিন্ন রকমের দই চেখে দেখার সুযোগ মিলেছে।’
মেলায় এক, দুই ও তিন কেজির মাটির পাত্রে দই বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজির দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা।
নাটোরের শ্রীপুর থেকে মেলায় এসেছেন দই বিক্রেতা তানু কাজী। তিনি বলেন, ‘মানুষ ভালো দই খেতে চায়। কিন্তু দাম দিতে চায় না। সবকিছুর দাম বাড়ছে। তাই দইয়ের ব্যবসা আর আগের মতো নেই। তবু মনের টানে প্রতিবছরই এ মেলায় আসি।’
এ বছর সরস্বতীপূজা দুই দিনের তিথিতে পড়েছে। তাই গতকাল রোববার বিকেল থেকে বিভিন্ন এলাকার দই বিক্রেতারা আসতে শুরু করেন। মেলায় দইয়ের পাশাপাশি ঝুরি, মুড়ি-মুড়কি, চিড়া, বাতাসা, কদমাসহ বিভিন্ন খাবার বিক্রি হয়েছে।
তাড়াশের এই দইমেলার রয়েছে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। রয়েছে নানা কাহিনি ও জনশ্রুতি। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় আড়াই শ বছর ধরে দইমেলা হচ্ছে। তৎকালীন জমিদার বনোয়ারী লাল রায় বাহাদুর দইমেলার প্রচলন করেন। তিনি দই ও মিষ্টান্ন পছন্দ করতেন। তাই জমিদারবাড়িতে আসা অতিথিদের আপ্যায়নে এ অঞ্চলের ঘোষদের তৈরি দই পরিবেশন করতেন। তখন থেকেই জমিদারবাড়ির সামনে রশিক রায় মন্দিরের মাঠে সরস্বতীপূজা উপলক্ষে তিন দিনের দইমেলার প্রচলন হয়।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা: সিরাজগঞ্জ’ শীর্ষক বইয়ে তাড়াশের এ দইমেলার বর্ণনা রয়েছে। বইটির প্রধান সম্পাদক শামসুজ্জামান খান বিস্তারিতভাবে এ মেলার বিবরণ দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, একসময় এ মেলায় ৭০০ থেকে ৮০০ জন ঘোষ ৮ থেকে ১০ হাজার মণ দই নিয়ে এসে বিক্রি করতেন। তখন অবশ্য মেলা হতো তিন দিনের। বর্তমানে দিনব্যাপী মেলায় কয়েক শ মণ দই বিক্রি হয়।
দইয়ের স্বাদের কারণে নামেরও আছে ভিন্নতা। ক্ষীরসা দই, শাহী দই, শেরপুরের দই, বগুড়ার দই, শ্রীপুরী দই প্রভৃতি বাহারি নাম। দামেও রয়েছে হেরফের। বগুড়ার শেরপুর, রায়গঞ্জের চান্দাইকোনা, গুরুদাসপুরের শ্রীপুর, উল্লাপাড়ার ধরইল, চাটমোহরের হান্ডিয়াল ও তাড়াশের দইয়ের চাহিদা বেশি।
তাড়াশ উপজেলা সনাতন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সনাতন দাশ জানান, ঐতিহ্য মেনে সরস্বতীপূজার দিনে তাড়াশে দইমেলা হয়। সুষ্ঠু পরিবেশে এ মেলা সম্পন্ন করতে দলমত-নির্বিশেষে সবাই কাজ করেন।