হিলি স্থলবন্দরে লাগেজ পার্টির কাছে ‘জিম্মি’ যাত্রী

শুল্ক স্টেশন ও শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আর্থিক সুবিধা দিয়ে পাচারকারীরা কার্যক্রম চালায়।

হিলি স্থলবন্দরের চেকপোস্ট পার হয়ে আসছেন যাত্রীরা। সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

ভারত থেকে আসা যাত্রীদের অনেকের সঙ্গে পাঁচ থেকে ছয়টি লাগেজ আসে। লাগেজে থাকে খাদ্যপণ্য ও প্রসাধনসামগ্রী। শূন্যরেখা পার হলেই সেগুলো চলে যায় লাগেজ পার্টি হিসেবে পরিচিত মালামাল পাচারকারীদের হাতে। ভারত সীমান্তে ওত পেতে থাকা পাচারকারীরা কৌশলে যাত্রীদের কাছে লাগেজগুলো ধরিয়ে দেয়। শূন্যরেখা পার হওয়ার পরপরই লাগেজ পার্টির সদস্যরা লাগেজ নিয়ে সটকে পড়েন।

এভাবেই শুল্ক ফাঁকি দিয়ে দিনের পর দিন দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে মালামাল আনছে পাচারকারীরা। তাদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ সাধারণ যাত্রীরা। কোনো যাত্রী তাদের কথামতো মালামাল আনতে রাজি না হলে তাঁকে বন্দর এলাকায় হয়রানির শিকার হতে হয়। অভিযোগ আছে, লাগেজ পার্টির মদদদাতা স্থানীয় প্রভাবশালীসহ শুল্ক স্টেশন ও শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী।

তবে হিলি স্থলবন্দর শুল্ক স্টেশনের উপকমিশনার বায়জিদ হোসেন বলেন, বন্দরে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এর মধ্যে জনবলসংকট অন্যতম। ইতিমধ্যে ৮৫ জন সিপাহি নিয়োগ হয়েছে। কিছুসংখ্যক এ বন্দরে আসবে। তখন সমস্যা কিছুটা কাটিয়ে ওঠা যাবে। আর্থিক সুবিধা নিয়ে লাগেজ পার্টিকে সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা সত্য নয়। অনিয়ম যদি কেউ করে থাকে, তাহলে অন্য বিভাগের সদস্যরা করছেন। রাজস্ব অফিসের কারও অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই।

শুল্ক স্টেশন থেকে পাওয়া তথ্যমতে, শুল্ক আইনানুযায়ী কোনো যাত্রী দেশে আসার সময় ৪০০ মার্কিন ডলার (৪৪ হাজার টাকা) মূল্যমানের পণ্য সঙ্গে আনতে পারেন। কিন্তু চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ আগস্ট পর্যন্ত ভারত থেকে অবৈধভাবে আসা ১ হাজার ৩৩৫টি ডিএমের (আটক রসিদ) মাধ্যমে ৯৫ লাখ ৬৯ হাজার ৭৯৩ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। এ ছাড়া শুল্ক স্টেশনে জব্দ করা ডিএমভুক্ত (সংরক্ষণযোগ্য না) ২০টি পণ্য প্রকাশ্য নিলামের মাধ্যমে ৩৪ লাখ ৭০ হাজার ২৭০ টাকার রাজস্ব আয় হয়। এর বাইরে অনেক মালামাল জব্দ তালিকায় না থাকার অভিযোগও আছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক সংবাদকর্মী বলেন, সারা দিন যেসব পণ্য জব্দ করা হয়, দিন শেষে পুরোটা জব্দ তালিকায় আসে না। এ ক্ষেত্রে শুল্ক স্টেশনে দায়িত্বরত ব্যক্তিদের সহায়তায় অনেকেই মালামাল ছাড় করে নিয়ে যান।

চেকপোস্ট এলাকায় যাত্রীদের মালামাল পারাপারে নিয়োজিত শ্রমিকদের কোনো পরিচয়পত্র না থাকায় যে যাঁর মতো শ্রমিক সেজে এ কাজে যুক্ত হচ্ছেন। শ্রমিকদের তালিকার ব্যাপারে শুল্ক বিভাগের রাজস্ব কর্মকর্তা তাপস কুমার রায় বলেন, ‘আমাদের কাজ রাজস্ব আদায় করা। বন্দর সুরক্ষা দেবে স্থানীয় প্রশাসন (বিজিবি ও আনসার)। বন্দরের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে আরও জনবল প্রয়োজন। মাত্র ১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। তাঁদের মধ্যে সাতজন সিপাহি, একজন রাজস্ব কর্মকর্তা, দুজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা। প্রশাসনের সঙ্গে শুল্ক কার্যালয়ের কাজের সমন্বয় নেই।’

স্থলবন্দর এলাকার বাসিন্দা মাহবুব হোসেন বলেন, ‘গত মাসে ভারত থেকে একটা আইপিএস কিনি। কাস্টমস আমাকে আটকাল। অথচ আমার সঙ্গে স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত এক ব্যক্তি তিনটা আইপিএস আনল সাধারণ যাত্রীর সহায়তা নিয়ে। সিপাহিরা তাঁকে জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করলেন না। যাঁরা দায়িত্বে আছেন, তাঁরাই লাগেজ পার্টিকে আশকারা দিয়ে তাঁদের কাছে আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন। কোনো যাত্রী তাঁদের কথামতো মালামাল আনতে রাজি না হলে তাঁকে বন্দর এলাকায় হয়রানির শিকার হতে হয়।’

বন্দরে লাগেজ পার্টির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে হেনস্তার শিকার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের ১ অক্টোবর লাগেজ পার্টি সদস্যদের হাতে হেনস্তার শিকার হন কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী। এ ঘটনায় হাকিমপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তাঁরা। এ ছাড়া ২৬ মার্চ শুল্ক স্টেশনে কর্মরত আনসার সদস্য মাসুদ রানা লাগেজ পার্টির সদস্যদের হেনস্তার শিকার হয়ে থানায় জিডি করেন।

জানতে চাইলে রাজস্ব কর্মকর্তা তাপস কুমার রায় বলেন, ‘আমরা একাধিকবার প্রতিবাদ করে গালিগালাজ ও হুমকির শিকার হয়েছি। অনেক সময় পুলিশের সহযোগিতা নিতে হয়েছে।’

সর্বশেষ ৩০ আগস্ট দুপুরে বন্দরের চেকপোস্ট এলাকায় সংবাদ সংগ্রহকালে প্রথম আলোর বিরামপুর প্রতিনিধির ওপর অতর্কিতে হামলা করে লাগেজ পার্টির সদস্যরা। সিসিটিভি ফুটেজ ও মুঠোফোনে ধারণ করা ভিডিওতে হিলি শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মচারী জুয়েল হোসেনকে হামলার নির্দেশ দিতে দেখা যায়। এ ঘটনায় ইমিগ্রেশন ও হাকিমপুর থানা-পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ফুটেজ দেখে পাচারকারী চক্রের দুই সদস্যকে আটক করে। পরে মামলা হলে তাঁদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।

হাকিমপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু সায়েম মিয়া বলেন, সম্প্রতি গ্রেপ্তার দুজনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তারে তাঁরা কাজ করছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শূন্যরেখা থেকে বাংলাদেশ অংশে দেড় শ গজ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব বিজিবির। সেটা পুলিশের এখতিয়ারের মধ্যে না থাকায় তাঁদের তেমন কিছুই করার থাকে না।