বরিশাল অঞ্চলে আবাদি জমি কমেছে, তবে বাড়ছে ফসলের উৎপাদন

পাকা আমন ধান কাটছেন কৃষক। সম্প্রতি ঝালকাঠির বালিঘোনা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

বরিশাল অঞ্চলে নগরায়ণ, সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন প্রকল্প, বসতবাড়ি নির্মাণ, লবণাক্ততা, নদীভাঙনসহ নানা কারণে গত এক দশকে আশঙ্কাজনক হারে কৃষিজমি কমেছে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সিডর-আইলা-আম্পানের মতো ঘূর্ণিঝড়, খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস কৃষি খাতকে বহুমুখী ঝুঁকিতে ফেলেছে। এর মধ্যেও এ অঞ্চলে প্রতিবছর ধান-চালের উৎপাদন বাড়ছে।

২০১৪ সালে বিভাগের ৬ জেলায় প্রায় সাড়ে ৭ লাখ হেক্টর জমিতে ২০ লাখ ৫৯ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হয়। পাঁচ বছর পর ২০১৯ সালে ধান আবাদ হয় ৭ লাখ ২১ হাজার হেক্টরে। চলতি মৌসুমে তা আরও কমে ৭ লাখ ১ হাজার ৯০৩ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ৯ বছরে বিভাগে ধানের আবাদ কমেছে প্রায় ৪৮ হাজার হেক্টর। আবাদি জমির পরিমাণ কমলেও ২০১৯ সাল থেকে ফি বছর আমন, আউশ ও বোরো মিলিয়ে চালের উৎপাদন ২৯ থেকে ৩১ লাখ মেট্রিক টন পর্যন্ত হয়েছে। অর্থাৎ সাড়ে ৬ শতাংশ আবাদি জমি কমলেও ফসলের উৎপাদন বেড়েছে দেড় গুণ।

কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, বরিশাল অঞ্চলে হাইব্রিড জাতের আমনের আবাদ এখনো দুই শতাংশের কম। বিপুল সম্ভাবনাময় এ ফসলে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন আসছে না। উফশী জাতের প্রবর্তন করতে পারলে শুধু আমনেই অন্তত ১০ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ আছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রিয় লাল চন্দ্র পাল বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে আমন মৌসুমে উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাত আবাদ বাড়াতে পারলে উৎপাদন আরও বাড়বে।

এবার আমরা ব্রি-৬৭, ৭৪, ৮৯, ৯২, ৯৯ জাতের ধান আবাদ করেছিলাম। প্রতি দুই শতক জমিতে ১০৫ কেজি ধান পেয়েছি। ওই জমি আগে পতিত থাকত। সম্মিলিতভাবে এলাকার ৩০০ কৃষক বোরো আবাদ করে সবার চোখ খুলে দিয়েছে।
মাসুদ চৌধুরী, চরকগাছিয়া গ্রামে বোরো আবাদকারী প্রথম কৃষক

জমি কমছে যেভাবে

পটুয়াখালী জেলা প্রশাসন ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) তথ্যমতে, পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের জন্য প্রায় ৫ হাজার ৭৫৪ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ হয়েছে। এর সিংহভাগই কৃষিজমি। আরও আড়াই শ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান।

বরিশাল বিভাগে একটি সিটি করপোরেশন ও ২৬টি পৌরসভা রয়েছে। এসব পৌরসভার আয়তন প্রতিবছরই বাড়ছে। এসব শহর ঘিরে উপশহর বাড়ছে। এতে ব্যবহার হচ্ছে কৃষিজমি। ২০০২ সালে বরিশাল সিটির আয়তন ২৫ বর্গকিলোমিটার থেকে দাঁড়ায় ৫৮ বর্গকিলোমিটারে। বরিশাল নগরের কীর্তনখোলা নদীর পূর্ব পারে কর্ণকাঠি এলাকায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস স্থানান্তরের পর ওই এলাকা ঘিরে অন্তত ২০০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত ঘিরে ৩০টি আবাসন কোম্পানি ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গত ১০ বছরে অন্তত ২০০ হেক্টর কৃষিজমি কিনে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এভাবে গত এক দশকে বিভাগে ধানের আবাদি জমি কমেছে প্রায় ৪৮ হাজার হেক্টর।

এবার বরিশাল বিভাগে আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। বরগুনার আমতলী বাঁধঘাট হাটে চলছে আমন ধানের বেচাকেনা। গত বুধবার
ছবি: প্রথম আলো

যেভাবে বাড়ল উৎপাদন

কৃষি বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, গত এক দশকে বরিশাল অঞ্চলে ধানের উৎপাদনে সাফল্যের পেছনে কৃষি বিভাগ, বেসরকারি সংস্থা ও কৃষকদের সমন্বিত প্রচেষ্টা অবদান রেখেছে। উৎপাদন বাড়ার পেছনে জমি তিন ফসলি করা, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং উফশী জাতের ধান আবাদই বেশি ভূমিকা রেখেছে। স্থানীয় জাতের প্রতিটি ধানের ছড়ায় ২৯টি ধান হয়। উফশীতে হয় ৩৯ থেকে ৪৫টি।

সিডরবিধ্বস্ত বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের চরকগাছিয়া গ্রামের কৃষকেরা আগে শুধু আমন আবাদ করতেন। ২০০৭ সালে সিডরের পর থেকে আমন আবাদে বাধার সম্মুখীন হন কৃষকেরা। এই গ্রামের কৃষক মোখলেসুর রহমান বলেন, ২০১৭ সালের পর সরকারি-বেসরকারি সহায়তায় তাঁদের এক ফসলি জমি দুই ফসলি হতে শুরু করে। একই জমিতে প্রথমে আউশ ও পরে আমনের আবাদ করেন। চলতি বছর থেকে কয়েকজন পরীক্ষামূলকভাবে বোরো আবাদ শুরু করেছেন।

আগে এ অঞ্চলের জমিতে শুধু আমন আবাদ হতো। সাত মাস ওই জমি পতিত থাকত। ২০১৯ সাল থেকে এলাকায় আমনের পাশাপাশি আউশ আবাদে ঝোঁকেন কৃষকেরা। এরপর ২০২০ সালে করোনার সময় বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকটের পূর্বাভাস দিলে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ ও প্রণোদনায় উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর আওতায় আমন-আউশের পাশাপাশি বোরো আবাদ শুরু হয়েছে।
আবু সৈয়দ মো. জোবায়দুল আলম, উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বরগুনা

চরকগাছিয়া গ্রামে প্রথম বোরো আবাদের কথা ভাবেন কৃষক মাসুদ চৌধুরী। তিনি স্থানীয় কৃষি বিভাগের সহায়তায় স্থানীয় ৩০০ কৃষককে নিয়ে ২০০ বিঘা জমিতে প্রথমবারের মতো বোরো আবাদ করেন। মাসুদ চৌধুরী বলেন, ‘এবার আমরা ব্রি-৬৭, ৭৪, ৮৯, ৯২, ৯৯ জাতের ধান আবাদ করেছিলাম। প্রতি দুই শতক জমিতে ১০৫ কেজি ধান পেয়েছি। ওই জমি আগে পতিত থাকত। সম্মিলিতভাবে এলাকার ৩০০ কৃষক বোরো আবাদ করে সবার চোখ খুলে দিয়েছে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরগুনার উপপরিচালক আবু সৈয়দ মো. জোবায়দুল আলম বলেন, চলতি বছর জেলায় ৯ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করে ৪০ হাজার ৫২৪ টন ধান উৎপাদিত হয়েছে। আগে এ অঞ্চলের জমিতে শুধু আমন আবাদ হতো। সাত মাস ওই জমি পতিত থাকত। ২০১৯ সাল থেকে এলাকায় আমনের পাশাপাশি আউশ আবাদে ঝোঁকেন কৃষকেরা। এরপর ২০২০ সালে করোনার সময় বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকটের পূর্বাভাস দিলে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ ও প্রণোদনায় উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর আওতায় আমন-আউশের পাশাপাশি বোরো আবাদ শুরু হয়েছে।

২০১৬ সালে বরিশাল বিভাগে আমন উৎপাদন হয় ১৬ লাখ ৩১ হাজার ৭১৪ টন, ২০২২ সালে হয় ১৬ লাখ ২৭ হাজার ৯৯৫ টন। ২০১৬ সালে আউশ উৎপাদন হয় ৩ লাখ ২১ হাজার ৯০৩ টন, ২০২২ সালে হয় ৬ লাখ ৫৫ হাজার ৬১৪ টন। ২০১৬ সালে বোরো উৎপাদন হয় ৫ লাখ ৬৪ হাজার ৪৪৬ টন, ২০২২ সালে হয় ৭ লাখ ১৪ হাজার ৯১৪ টন।

রোপণ করা ধানের জমিতে ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দিচ্ছেন কৃষক। সম্প্রতি বরিশালের উজিরপুর উপজেলার জয়শ্রী গ্রামে
ছবি: সংগৃহীত

উফশী ও লবণসহিষ্ণু ধানে বাজিমাত

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১০ সালে কলাপাড়ায় উফশী আবাদের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৩০৩ একর। উৎপাদন হয়েছিল ৩৮ হাজার ১৫০ টন। ২০২০ সালে আবাদ বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫ হাজার ৩৩২ একরে। উৎপাদন হয় ৭৯ হাজার ৪৮৩ টন। অর্থাৎ ১০ বছরে উফশীর আবাদ বাড়ে ৪৪ হাজার ৯২৯ একর জমিতে। উৎপাদন বেড়েছে ৩৩ হাজার ৯৮৭ টন। ২০২২ সালে উফশী আবাদ কিছুটা কমে ৫৫ হাজার ৫৭৫ একর হলেও উৎপাদন কমেনি। উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৯৬ হাজার ৭৫০ টন।

বেসরকারি সংস্থা সংগ্রামের অধীনে বাস্তবায়নাধীন ‘সাসটেইনেবল রাইস সিড প্রডাকশন অ্যান্ড ডেলিভারি সিস্টেম ফর সাউদার্ন’ (এসআরএসপিডিএস) প্রকল্পের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইউএসএআইডির অর্থায়নে এই প্রকল্পের আওতায় বরগুনা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুর জেলার ৩৪টি ইউনিয়নে কৃষকদের মধ্যে উফশী জাতের ধানের বীজ বিতরণ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। চার বছর ধরে প্রকল্পের আওতায় ৩ জেলার ২৪ হাজার ২১২ জন কৃষককে আউশ, আমন ও বোরোর উন্নত জাতের প্রায় ৭০ টন বীজ দেওয়া হয়। এরপর ওই এলাকায় ধানের উৎপাদন বেড়েছে।

প্রকল্পটির ফোকাল পারসন মাসউদ সিকদার বলেন, তাঁরা জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত চিহ্নিত করে দেখেন, বরিশাল বিভাগের কৃষিতে লবণাক্ততা ও প্লাবন সমস্যা বেশি। এ জন্য তাঁরা লবণসহিষ্ণু বিনা-১১ ও ব্রি-৪৭ চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করেন কৃষকদের। পাশাপাশি জোয়ারে প্লাবিত জমিতে যাতে ধানগাছ পচে না যায়, সে জন্য ব্রি-৫২ জাত আবাদে উদ্বুদ্ধ করেন। এ জাত পানিতে ১৪ দিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। উপকূলের যেসব জমিতে লবণাক্ততার কারণে আমন ছাড়া কিছুই আবাদ হতো না, সেখানে গত চার বছর আমন, আউশ, বোরো আবাদ করছেন চাষিরা। এখন তাঁরা দু-তিন গুণ ফসল পেয়ে লাভবান হচ্ছেন।

ধানের চারা রোপণ করতে একটি জমিতে মই দিচ্ছেন কৃষক, পাশের জমিতে পাওয়ার টিলার দিয়ে চাষ করছেন আরেকজন। গত ১৫ জানুয়ারি ঝালকাঠির বিনয়কাঠি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

অবদান রয়েছে যন্ত্রের

কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, দেশে গত এক যুগে কৃষি খাতে যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। একই সঙ্গে স্থানীয় জাতের পরিবর্তে ‘ব্রি’ উদ্ভাবিত জাতগুলো সহজেই গ্রহণ করেছেন কৃষকেরা। এর সুফল মিলছে মোট উৎপাদনে।

বরিশাল আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আলিমুর রহমান বলেন, কৃষকেরা সনাতন ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে এসে এখন এক ফসলি জমিকে দ্রুত বহু ফসলি করায় উদ্যোগী হচ্ছেন। একই সঙ্গে জমি তৈরিতে পাওয়ার টিলারের ব্যবহার, সেচ দিতে সেচযন্ত্র ও ধান মাড়াই করতে মাড়াইযন্ত্রের ব্যবহার উৎপাদন বৃদ্ধির নেপথ্যে কাজ করছে।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রকল্পের আওতায় বরিশাল বিভাগে ১ লাখ ৫৭ হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় এসেছে। তবে ১০ বছর আগেও সেচের আওতায় জমির পরিমাণ ছিল এর অর্ধেকের কম। মূলত বোরোর আওতা বৃদ্ধির সঙ্গে এই বিভাগে সেচের জমির আওতাও বাড়ছে।