কুমিরার পরিত্যক্ত হাসপাতালটি যেন ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত’ ভবন

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা রেলস্টেশন এলাকায় পাহাড়ের টিলায় অবস্থিত রেলওয়ের পরিত্যক্ত বক্ষব্যাধি হাসপাতাল ও সেনেটোরিয়াম (স্বাস্থ্যনিবাস) ভবনছবি: প্রথম আলো

প্রথম দেখায় মনে হবে ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত’ ভবন। ভবনের ছাদ, জানালা, মেঝের ও দেয়ালের ইট ও রড কিছুই নেই। শুধু দাঁড়িয়ে রয়েছে ভবনের ধ্বংসাবশেষ।

এ চিত্র চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা রেলস্টেশন এলাকায় পাহাড়ের টিলায় অবস্থিত রেলওয়ের পরিত্যক্ত বক্ষব্যাধি হাসপাতাল ও সেনেটোরিয়াম (স্বাস্থ্যনিবাস) ভবনের। বছরের পর বছর ধরে এ অবস্থায় পড়ে আছে হাসপাতালটি। একসময় এই অবকাঠামো রক্ষায় নিরাপত্তাপ্রহরী থাকলেও ১৫ বছর ধরে তা-ও নেই।

যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত রেলওয়ের কর্মী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ আমলে এই হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছিল।

রেলওয়ে সূত্র বলছে, যক্ষ্মা থেকে মুক্তির জন্য লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে পাহাড়ের টিলায় এ হাসপাতাল নির্মাণ করে রেলওয়ে। যক্ষ্মা কমে আসার পর ১৯৯২ সালে হাসপাতালটি কুমিরার এই ভবন থেকে স্থানান্তর করে চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত সিআরবি এলাকার রেলওয়ে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এরপর থেকে ১০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের বিশাল এই জায়গা ও ভবন নিয়ে রেলওয়ে কোনো পরিকল্পনা করেনি। আবার চট্টগ্রাম নগরে স্থানান্তর করা হাসপাতালটিও কার্যত বন্ধ রয়েছে।

রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ইবনে সফি আবদুল আহাদ প্রথম আলোকে বলেন, পরিত্যক্ত হাসপাতালের জায়গায় হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বেসরকারি হাসপাতালকে ইজারা দেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছিল। মন্ত্রী-সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও জায়গাটি পরিদর্শন করেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত হয়েছে, জানা নেই।

দীর্ঘদিন ধরে কোনো নিরাপত্তাপ্রহরী নেই। দিনদুপুরে দুষ্কৃতকারীরা ভবনের ইট, রড খুলে নিয়ে গেছে

আছে শুধু ধ্বংসাবশেষ

সীতাকুণ্ডের কুমিরা রেলস্টেশন থেকে প্রায় ২০০ ফুট ওপরে পাহাড়ের টিলায় হাসপাতাল ভবনের অবস্থান। তিনটি ভবন নিয়ে এ হাসপাতাল ও সেনেটোরিয়াম গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ আমলে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, ভবনের কোনো কক্ষেরই দরজা-জানালা নেই। আশপাশের ইটও খুলে নেওয়া হয়েছে। বারান্দায় পড়ে রয়েছে খোয়া। বিভিন্ন খুঁটির রডও খুলে নেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে এখানে কোনো নিরাপত্তাপ্রহরী নেই। দিনদুপুরে দুষ্কৃতকারীরা ভবনের ইট, রড খুলে নিয়ে যায়। কেউ বাধা দেয় না। হাসপাতালের অবকাঠামো রক্ষায় উদাসীন রেলওয়ের বিভাগীয় প্রকৌশল বিভাগও।

কুমিরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোরশেদ হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, একসময় হাসপাতালটি এ অঞ্চলের যক্ষ্মা রোগীদের একমাত্র ভরসা ছিল। কয়েক বছর ধরে স্থানীয় দুষ্কৃতকারীরা ভবনটির ইট, রড খুলে নিয়ে গেছে। যদি ভবনের ছাদ, দেয়াল থাকত, সেটি ভাড়া কিংবা ইজারা দিলে রেলের কিছুটা আয় হতো। রেল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় সুন্দর ভবনগুলো লুট হয়ে গেছে।

জানতে চাইলে স্টেশনমাস্টার সাইফুদ্দিন বশর প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা রেলস্টেশনের রেলপথ নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত। স্টেশনের বাইরে তাঁর যাওয়ার সুযোগ নেই। টিবি হাসপাতালের ইট লুটের বিষয়টি দেখার দায়িত্ব তাঁর নয়।

রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, ওই ভবন থেকে রেলের কোনো আয় আসে না। ফলে নিরাপত্তাপ্রহরী নিয়োগ করা লোকসান। দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করা হয়েছে, কোনো সুফল নেই।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহীদুল ইসলাম বলেন, ভূমি ও ভবন-সংক্রান্ত মামলা হলে সেগুলোর তদন্ত করে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী। ফলে এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় প্রকৌশলী আবদুল হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, ভবন পাহারায় আনসার সদস্য রাখলে মাসে এক লাখ টাকা খরচ হবে। কিন্তু বিপরীতে রেলের কোনো আয় হবে না। তাই এই জায়গা ইজারা দেওয়ার বিকল্প নেই। একাধিকবার ইজারা দেওয়ার চেষ্টা করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু নানা কারণে ইজারা হয়নি।

নেই পরিকল্পনা

রেলওয়ের ভূসম্পত্তি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতাল এলাকার আয়তন প্রায় ১০ একর। এ ছাড়া হাসপাতালের আশপাশে রেলওয়ের জায়গায় রয়েছে আরও অন্তত ৩০ একর। অর্থাৎ হাসপাতাল ও হাসপাতাল ঘিরে রেলওয়ের জায়গার পরিমাণ ৪০ একর।

বর্তমানে এই এলাকার মৌজা দর অনুযায়ী, এক একর জমির মূল্য ২৮ লাখ টাকা। এই দর অনুযায়ী শুধু হাসপাতাল এলাকায় থাকা জায়গার দাম ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, বর্তমানে এই এলাকায় জায়গাজমি মৌজার দরের চেয়ে তিন গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। বাজারদর অনুযায়ী, হাসপাতালের জমির দাম অন্তত ৯ কোটি টাকা। আর হাসপাতাল ও হাসপাতাল-সংলগ্ন জায়গার দাম ১১ কোটি ২০ লাখ টাকা।

মূল্যবান এই জায়গা নিয়ে রেলওয়ের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানা গেছে। দুই বছর আগে পরিত্যক্ত হাসপাতাল পরিদর্শন করেছিলেন রেলসচিব হুমায়ুন কবির। তখন একটি বেসরকারি হাসপাতালকে এই জায়গা দেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছিল। পরে তা আর এগোয়নি।

রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কুমিরায় রেলওয়ের পরিত্যক্ত হাসপাতাল নিয়ে আপাতত কোনো কিছু করার পরিকল্পনা নেই। তবে রেলওয়ের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনায় এই হাসপাতালের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হবে।