চট্টগ্রামে শতবর্ষী গাছ কেটে এক্সপ্রেসওয়ের র‍্যাম্প নামাতে চায় সিডিএ

চট্টগ্রাম নগরের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‍্যাম্প নামানোর জন্য শতবর্ষী গাছ কাটতে গায়ে দেওয়া হয়েছে নম্বর। আজ বেলা দেড়টায় সিআরবি এলাকায়ছবি: সৌরভ দাশ

চট্টগ্রাম নগরের টাইগারপাস থেকে পলোগ্রাউন্ড পর্যন্ত মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী সড়কটি নগরবাসীর কাছে ‘দ্বিতল’ সড়ক হিসেবে পরিচিত। সুবজে ঘেরা অনন্য এই সড়কের একটি অংশ গেছে পাহাড় ঘেঁষে ওপর দিয়ে। আরেকটি অংশ নিচে। মধ্যবর্তী পাহাড়ি ঢালে রয়েছে ছোট-বড় শতাধিক বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। এসব গাছে রয়েছে নানা প্রজাতির পাখির বাসা। এখন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‍্যাম্প (গাড়ি ওঠার পথ) নির্মাণ করতে গাছগুলো কাটতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। ইতিমধ্যে গাছগুলোতে লাল ও সাদা কালি দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে।

র‍্যাম্প নির্মাণের জন্য গাছ কাটার উদ্যোগের বিরোধিতা করেছেন নগর–পরিকল্পনাবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। তাঁরা বলছেন, যেসব গাছ কাটা যাবে, তার মধ্যে শতবর্ষী গাছ আছে। গাছগুলো রক্ষায় এই অংশে র‍্যাম্প নির্মাণের দরকার নেই। গাছ কেটে র‍্যাম্প নির্মাণ করা হলে সড়কের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে।

রেলওয়ের কর্মকর্তারা পরিবেশের গুরুত্ব বিবেচনা করে অন্য কোথাও র‍্যাম্প নির্মাণের অনুরোধ জানালে তা রাখেনি সিডিএ। অবশ্য প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিডিএ ও বন বিভাগ বলছে, এই র‍্যাম্প নির্মাণ করতে হলে গাছ কাটতে হবে।

এর আগে নগরের মুরাদপুর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত আখতারুজ্জামান চৌধুরী উড়ালসড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে সড়কদ্বীপে থাকা অনেক গাছ কেটেছিল সিডিএ।

সিডিএ চট্টগ্রাম নগরের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ১৪ নভেম্বর ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করেন। মূল অংশের নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ শেষ না হওয়ায় যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়নি। এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা।

কাটা পড়বে শতবর্ষী গাছও

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ১৫টি র‍্যাম্প (গাড়ি ওঠা-নামার পথ) রয়েছে। এর মধ্যে টাইগারপাসে রয়েছে দুটি। একটি দিয়ে গাড়ি উঠবে এবং আরেকটি দিয়ে নামবে। গাড়ি ওঠার র‍্যাম্পটি নির্মাণ করা হচ্ছে নিউমার্কেট থেকে টাইগারপাসমুখী অংশ দিয়ে। আর এই র‍্যাম্প নির্মাণ করতে গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিডিএ। ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হলেও নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থাকা গাড়ি নামার র‍্যাম্পটির (আমবাগান সড়কমুখী) নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে।

বন বিভাগ সূত্র জানায়, র‍্যাম্প নির্মাণের জন্য গাছ কাটার অনুমতি চেয়ে সিডিএ সম্প্রতি বন বিভাগের কাছে আবেদন করে। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৪৬টি গাছ কাটার অনুমতি দেয়। গাছগুলোর মধ্যে রয়েছে শিরীষ, মেহগনি, কৃষ্ণচূড়া, পেয়ারা প্রজাতির গাছ।

কাটার জন্য নম্বর দেওয়া এসব গাছে রয়েছে অসংখ্য পাখির আবাস। আজ বেলা দেড়টায় সিআরবি এলাকায়
ছবি: সৌরভ দাশ

আজ রোববার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, নগরের টাইগারপাস মোড়ের পাশে দুটি বিশাল আকৃতির শিরীষ গাছে সাদা রং দিয়ে ক্রমিক নম্বর দেওয়া হয়েছে। এরপর ওপর ও নিচের সড়কের মাঝখানের ঢালে ছোট ও বড় আকারের প্রায় ১০০ গাছ রয়েছে। কিছু গাছ ছাড়া প্রায় সব কটিতে একটি করে ক্রমিক নম্বর দেওয়া হয়েছে। কিছু গাছে ক্রমিক নম্বর দেওয়া হলেও তা লাল কালি দিয়ে মুছে দেওয়া হয়েছে। গাছগুলোতে রয়েছে বিভিন্ন পাখির বাসা। গাছগুলোর কারণে দুই পাশে ছায়া থাকে। তীব্র গরমের সময়ে এখানে বিশ্রাম নেন শ্রমজীবী মানুষ।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) এস এম কায়চার আজ বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, র‍্যাম্প কি লাগবে না? এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‍্যাম্প তো নির্মাণ করতে হবে। এটা সরকারি কাজ, জরুরি কাজ। তাই অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এটি ছোটখাটো জিনিস। বড় কোনো গাছ কাটার অনুমোদন দেওয়া হয়নি।

টাইগারপাস ও সিআরবি এলাকায় গাছ কেটে র‍্যাম্প নির্মাণের পরিকল্পনায় ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও নগর–পরিকল্পনাবিদ জেরিনা হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই শহরকে বাঁচিয়ে রাখা হবে না? সিডিএ যেভাবে কাজ করে যাচ্ছে, তা রীতিমতো আতঙ্কের। সংস্থাটির পেশাদারত্ব নেই, জবাবদিহি নেই। এভাবে কেন গাছ কাটবে? এ জন্য সিডিএকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। সিআরবি রক্ষায় যেভাবে সবাই এগিয়ে এসেছিল, ঠিক গাছগুলো রক্ষায়ও সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’

এর আগে ২০২১ সালে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সবুজে ঘেরা জায়গা সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এর প্রতিবাদে আন্দোলনে নামে নাগরিক সমাজ। নাগরিক সমাজের প্রতিবাদের মুখে সে হাসপাতাল হয়নি।

সবুজে ঘেরা সড়কটির গাছ কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছে সিডিএ। আজ বেলা দেড়টায় সিআরবি এলাকায়
ছবি: সৌরভ দাশ

বেসরকারি সংগঠন ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান অপিনিয়নের (ইকো) উদ্যোগে ২০২১ সালে নগরের সিআরবির প্রাণবৈচিত্র্য নিয়ে জরিপ করা হয়েছিল। ওই জরিপে সিআরবি এলাকায় মোট ২২৩টি প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে বড় বৃক্ষ ৮৮ প্রজাতি, গুল্ম ৪১ প্রজাতি, বীরুৎ ৭২ প্রজাতি এবং লতাজাতীয় ২২টি প্রজাতি রয়েছে। শুধু সিআরবি এলাকায় ঔষধি উদ্ভিদ পাওয়া গেছে ১৮৩ প্রজাতির।

এই জরিপের কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক রাসেল। তিনি আজ প্রথম আলোকে বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য যেসব গাছে ক্রমিক নম্বর দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বড় আকৃতির গাছগুলোর বয়স আনুমানিক ১০০ বছর হবে। এই গাছগুলোতে বিভিন্ন ধরনের পাখি ও পোকামাকড়ের বাসা রয়েছে। গাছগুলোকে কেন্দ্র করে প্রাণীদের বাস্তুসংস্থান (ইকোসিস্টেম) গড়ে উঠেছে। এখন গাছগুলো কেটে ফেললে পশুপাখির আবাস নষ্ট হবে। পরিবেশের ক্ষতি হবে। তাই এভাবে গাছ কেটে র‍্যাম্প নির্মাণ করা কোনোভাবে সমর্থন করা যায় না।

র‍্যাম্পের দরকার ছিল না

টাইগারপাস থেকে পলোগ্রাউন্ড পর্যন্ত র‍্যাম্প নির্মাণে ১৪ শতক জায়গা চেয়ে রেলওয়েকে ২৫ মার্চ চিঠি দিয়েছে সিডিএ। এ জায়গায় গাছগুলো রয়েছে। সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল অংশের নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে। আর র‍্যাম্প নির্মাণের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। পলোগ্রাউন্ড রোড–সংলগ্ন ১৪ শতক জায়গা ব্যবহারের অনুমতি প্রয়োজন।

গাছ কেটে র‍্যাম্প নির্মাণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিডিএর প্রকল্প পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, টাইগারপাসের এই অংশ ছাড়া র‍্যাম্প করার আর কোনো বিকল্প জায়গা নেই। এখানে র‍্যাম্প করতে গেলে গাছ কাটতে হবে। তবে বড় গাছগুলো যাতে কাটা না পড়ে, সে জন্য চেষ্টা করেছেন। তারপরও একটি-দুটি হয়তো কাটা পড়বে। গাছ কাটার বিষয়ে বন বিভাগের অনুমতি নেওয়া হয়েছে।

নীতিমালা অনুযায়ী জায়গা ব্যবহারের অনুমতির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিডিএ আমাদের জায়গায়টি পরিদর্শনে নিয়ে গিয়েছিল। তখন পরিবেশের কথা চিন্তা করে আমি ব্যক্তিগতভাবে র‍্যাম্পটি এখানে না নামিয়ে অন্য কোথাও করার সুযোগ রয়েছে কি না, তা বিবেচনা করার অনুরোধ করি।। তখন তাঁরা জানান, এ জায়গাকে কেন্দ্র করে নকশা করেছেন। অন্য কোনো জায়গায় নামানোর সুযোগ নেই। তারপরও নকশা সংশোধন করার অনুরোধ জানিয়েছিলাম।’

এ স্থানে র‍্যাম্পের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, এই দ্বিতল সড়ক শহরের জন্য অনন্য। এটির নান্দনিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। এই সড়কের যে গাছগুলো রয়েছে, তা অনেক পুরোনো। এই বয়সী গাছ এখন চট্টগ্রাম তো দূরে থাক, বাংলাদেশেও তেমন নেই। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে জিইসি মোড় ও আগ্রাবাদ থেকে ওঠার সুযোগ রয়েছে। তাই এই দুটি স্থানের মধ্যবর্তী জায়গা টাইগারপাসে র‍্যাম্প নির্মাণের দরকার ছিল না। হয়তো বেশি টোল পাওয়ার আশায় এই র‍্যাম্প নির্মাণ করছে। এর মাধ্যমে নগরের মানুষের স্বপ্নের ও স্বস্তির জায়গাগুলো যেভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে, তা অপরাধ।