চক্রটি প্রভাবশালী, সবাই চুপ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে সোনাই নদের পাড়ের খাসজমির মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি করা হচ্ছে। সম্প্রতি বুধন্তি এলাকাছবি: প্রথম আলো

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলায় এক স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা, সাবেক ইউপি সদস্যসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সোনাই নদীর পাড়ের খাসজমির মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। উপজেলা প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় দেড় মাস ধরে দিনরাত খননযন্ত্র দিয়ে মাটি কেটে নদীর পাড় সাবাড় করে ফেলছে এই চক্র।

বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০-এর ৪ নম্বর ধারায় বলা আছে, বিপণনের উদ্দেশ্যে কোনো উন্মুক্ত স্থান, চা-বাগানের ছড়া বা নদীর তলদেশ থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না।

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানন, উপজেলার বুধন্তি ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন, বুধন্তি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য শশই এলাকার বাসিন্দা সোলায়মান মিয়া ও তাঁর ভাই ওসমান মিয়া মাটি কাটার সঙ্গে জড়িত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার বুধন্তি ইউনিয়নের পশ্চিম দিক দিয়ে বয়ে গেছে সোনাই নদী। বুধন্তি ইউনিয়নের ইসলামপুর এলাকার সোনাই নদীর পাড়ের পূর্বদিকের হুরুগুনা খিলের মাঠসংলগ্ন এলাকায় একটি উঁচু টিলা রয়েছে। ওই উঁচু জায়গার পাশে নদী শ্রেণির জায়গা এবং বুধন্তি মৌজার ১ নম্বর খাস খতিয়ানের ৬০৫২ দাগে নদী শ্রেণির জায়গা থেকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা মনিরের নেতৃত্বে প্রায় দেড় মাসের বেশি সময় ধরে রাতের আঁধারে এক্সকাভেটর দিয়ে মাটি কাটা হচ্ছে। আর সোনাই নদীর পাড়ের বুধন্তি এলাকা থেকে সাবেক ইউপি সদস্য সোলায়মান ও তাঁর ভাই ওসমান মাটি কাটছেন। ওই মাটি ট্রাক্টরে তুলে পার্শ্ববর্তী জামান ইটভাটাসহ অন্যান্য ইটভাটায় নিয়ে বিক্রি করছেন তাঁরা।

এদিকে স্থানীয় লোকজনের একাধিকবারের অভিযোগের ভিত্তিতে গত শুক্রবার দুপুরে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাসহ অজ্ঞাতনামা সাত-আটজনকে আসামি করে বিজয়নগর থানায় মামলা করেন বুধন্তি ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা আবুল কাশেম।

স্থানীয় লোকজন জানান, গত এক থেকে দেড় বছর আগে নদী খননের মাটি পাড়ের জমিতে স্তূপ করে রাখা হয়। মাটি স্তূপ আকারে রাখায় তা উঁচু টিলার মতো হয়েছে। নদীর পাড়ের উঁচু জায়গার পাশে জায়গাটি খাস খতিয়ানের। টিলার মতো ওই উঁচু জায়গাসহ পাশের খাসজমি থেকে মাটি কেটে সাবাড় করেছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিরপাশা ও বুধন্তি গ্রামের তিনজন বলেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ও সাবেক মেম্বার এক মাসের বেশি সময় ধরে নদীর পাড়ের উঁচু টিলা এবং পাশের খাস খতিয়ানের জায়গার মাটি কেটে ট্রাক্টরে করে নিয়ে ইটভাটায় বিক্রি করছেন। দূরত্ববেদে ১ ট্রাক মাটি ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি করেন এই নেতা। ইটভাটার দূরত্ব ১০০ থেকে ২০০ গজের মধ্যে হলে ১ ট্রাক মাটি বিক্রি করে ১ হাজার ৮০০ টাকা এবং দূরত্ব যদি ৪০০ থেকে ৫০০ গজ হয় তাহলে এক ট্রাক মাটি আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। সাবেক ইউপি সদস্য সোলায়মান ও তাঁর ভাই ওসমানও নদীর পাড়ের বুধন্তি থেকে মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি করছেন। প্রতি রাতে অর্ধশতাধিক ট্রাক্টর মাটি নিয়ে বিক্রি করছেন তিনি। বেশির ভাগ মাটি বুধন্তির জামান ইটভাটায় নিয়ে বিক্রি করছেন তিনি।

বিরপাশা গ্রামের আবুল হোসেন বলেন, ‘মাটি কাইট্টা রাত্রে লইয়া যায়গা। চুরি কইরা মাটি কাটে তারা। রাতের বেলা হেরাকে কেডা বাধা দিব।’

তবে মনির হোসেন বলেন, ‘কেউ মাটি বিক্রি না করলে তো আর জমির মাটি আমি জোর করে নিতে পারব না। নদীর পাড়ের স্থানীয় মালিকদের কাছ থেকে জমি কিনে মাটি নিয়ে বিক্রি করছি। জামান ইটভাটাসহ বিভিন্ন ইটভাটায় বিক্রির পাশাপাশি কিছু জায়গাও ভরাট করেছি।’ তিনি বলেন, ‘এটি মরা গাঙ (নদী) ছিল। এটি ২০ থেকে ৫০ ফুট প্রশ্বস্ত ছিল। খনন করে এটি ১০০ থেকে ১৫০ ফুট প্রশ্বস্ত করা হয়েছে। খননের মাটি স্থানীয় মানুষের জমির ওপরে রাখা হয়েছে। অনেকে ওই মাটি বিক্রি করে দিয়েছে ও অনেকে পাড় কেটে জমির সঙ্গে মাটি মিলিয়ে ফেলেছে। এখন মানুষ শত্রুতা করে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে।’

সাবেক ইউপি সদস্য সোলায়মান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘নদীর পাড় থেকে আজ পর্যন্ত এক চিমটিও মাটি কাটি নাই। অভিযোগ সত্য নয়।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুবাইয়া আফরোজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাতে মাটি কাটার বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। রাতে যেন মাটি কাটতে না পারে, সে বিষয়ে খোঁজ রাখতে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’