এক মাস ধরে পানিবন্দী নোয়াখালীর ১২ লাখ মানুষ
ঘরের ভেতরে এক ফুটের মতো পানি ছিল; তা এখন নেমে গেছে। তবে ঘরের চারপাশে এখনো হাঁটুপানি। তাই অনেকটা ঘরবন্দী সময় কাটছে নোয়াখালীর সদর উপজেলার কাদিরহানিফ ইউনিয়নের পূর্ব লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামের মো. এছহাকের। এক মাসের বেশি সময় ধরে বন্যায় পানিবন্দী তাঁর পরিবার।
কেবল এছহাক নন, নোয়াখালীতে এখনো পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন ১২ লাখের বেশি মানুষ। জেলার আটটি উপজেলার মধ্যে ছয়টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা তাঁরা। এই ছয় উপজেলা হলো সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী সদর, কবিরহাট, চাটখিল ও সোনাইমুড়ী।
গতকাল মঙ্গলবার পূর্ব লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামে গিয়ে কথা হয় মো. এছহাকের সঙ্গে। তিনি ওই গ্রামের মনাছ মিয়ার বাড়ির বাসিন্দা। মো. এছহাক বলেন, পানিবন্দী অবস্থায় খুবই দুর্বিষহ সময় কাটছে তাঁর। বসতঘরে পানি ওঠার পর পরিবার-পরিজন নিয়ে পাশের বাড়ির এক প্রবাসীর বহুতল ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ঘর থেকে পানি নেমে যাওয়ার পর ফিরে আসেন। বন্যায় ঘরের মেঝেসহ অনেক মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে ঘরটি বসবাসযোগ্য করতে হয়েছে; কিন্তু ঘরের চারদিকে পানি না কমায় ভোগান্তি শেষ হচ্ছে না। মো. এছহাক বলেন, ‘ঘর থেকে বেরোলেই ময়লা পানি। কাদা আর ময়লা পানিতে পা চুলকায়। তবু এসব পানি না মাড়িয়ে উপায় নেই।’
মনাছ মিয়ার বাড়িতে ১৫টি পরিবারের বসবাস। প্রতিটি পরিবারের সদস্যরাই রয়েছেন পানির কারণে নানা ভোগান্তিতে। বাড়ির বাসিন্দা নিজাম উদ্দিনের টিনশেড ঘরের সামনে জমে রয়েছে হাঁটুপানি। সেই পানির সঙ্গে পুকুর-ডোবা, খাল-বিল এমনকি শৌচাগারের ময়লা পানি মিশে একাকার। বাড়ির বাসিন্দারা জানান, এসব নোংরা পানি বাধ্য হয়ে তাঁদের ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে বাসিন্দাদের ডায়রিয়াসহ অসুখ লেগেই আছে।
পূর্ব লক্ষ্মীনারায়ণপুরের হিংসা মার্কেটের ভেতর দিয়ে পাশের কাঞ্চনপুর এলাকার দিকে গেছে একটি সড়ক। সড়কটির পিচঢালাই উঠে বিভিন্ন স্থানে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে সড়কে ইটও অবশিষ্ট নেই। সড়কের কিছু স্থানে হাঁটুপানি, কোথাও আবার গোড়ালিসমান পানি জমে আছে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়কটি দিয়ে প্রায় দেড় কিলোমিটার অতিক্রম করে একই ইউনিয়নের কাঞ্চনপুর গ্রাম। সেই গ্রামে গিয়েও দেখা যায়, এখনো পানি মাড়িয়ে চলাচল করতে হচ্ছে বাসিন্দাদের। জাকের হোসেন নামের এক বাসিন্দা জানান, তিনি শহরের নতুন বাসস্ট্যান্ডের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তাঁর ঘরের ভেতরে এখনো কাদা। এর মধ্যে পানি মাড়িয়ে প্রতিদিন দোকানে যেতে হচ্ছে। সড়কও বেহাল। বন্যার পানির সঙ্গে লড়াই করতে করতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন বলে জানান তিনি।
কাঞ্চনপুর গ্রামের আরেক বাসিন্দা অলি উল্যাহ বলেন, বাড়ির উঠানে এখনো হাঁটুসমান পানি। পানি নড়ছে না। ৭০ বছর বয়সী এই বৃদ্ধ বলেন, বন্যায় তাঁর পুকুরে চাষ করা মাছ, খেতের ফসল সবই গেছে। এমন বন্যা তিনি আর কখনো দেখেননি।
সেনবাগ উপজেলার কেশারপাড় ইউনিয়নের খাজুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জামাল হোসেন বলেন, তাঁর বিদ্যালয়ের একতলা ভবনের পাকা মেঝেতে এখনো পানি। বৃষ্টি না হলে কমতে আরও দু-তিন দিন লাগবে। পানির কারণে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি একেবারেই কম।
পানিবন্দী এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পানিনিষ্কাশনের জন্য বেশ কয়েকটি খাল স্থানীয় প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবীদের উদ্যোগে পরিষ্কার করা হয়েছে। এর পরও পানি নামছে খুবই ধীরগতিতে। এর মধ্যে গত শুক্র ও শনিবার টানা বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা আরও বেড়েছে। নতুন করে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হয়েছে।
সোনাইমুড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কানিজ ফাতেমা প্রথম আলোকে বলেন, বন্যার পানি স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ নিয়েছে। তিনি উদ্যোগ নিয়ে কয়েকটি বড় খাল পরিষ্কার করিয়েছেন; কিন্তু পানি নামছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। তাই অনেক রাস্তাঘাট এবং বাড়ি এখনো পানিতে তলিয়ে রয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বন্যাকবলিত বিভিন্ন উপজেলায় ১২ লাখ ৬৫ হাজার ৩০০ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। এসব এলাকার ৩৬১টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র এখন চালু রয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে গতকাল পর্যন্ত আশ্রয়ে রয়েছেন ৩৫ হাজার ৮৩৪ জন।
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বন্যার পানি না সরার বিষয়টি তিনি জেলায় যোগদানের পরপরই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। এর মধ্যে কিছু এলাকা ঘুরে এসেছেন। এ বিষয়ে গতকাল বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।