চট্টগ্রামে বইমেলা শুরু, এখনো চলছে স্টলের সাজসজ্জা

অমর একুশে বইমেলা উদ্বোধন করেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। আজ বিকেল পাঁচটায় চট্টগ্রাম নগরের জিমনেশিয়াম মাঠেছবি: সৌরভ দাশ

অমর একুশে বইমেলার প্রবেশফটকই যেন বদলে যাওয়া বাংলাদেশের কথা বলছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন হয়েছে স্বৈরশাসকের। রাজপথের আন্দোলনে রক্ত ঝরেছে হাজারো মানুষের। সে রক্তের ঋণের কথা ভোলেনি আয়োজকেরা। প্রবেশফটকের দুই প্রান্তে রাখা হয়েছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ আবু সাঈদ আর ওয়াসিম আকরামের ছবি। মেলা প্রাঙ্গণেও রয়েছে আন্দোলনের ছাপ। জুলাই আন্দোলনের স্মৃতিকে সামনে রেখে স্টলও সাজানো হয়েছে।

২০২৪–এর জুলাই আন্দোলনকে সামনে রেখে চট্টগ্রামে শুরু হয়েছে অমর একুশে বইমেলা। আজ শনিবার বিকেলে চট্টগ্রাম নগরের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামসংলগ্ন জিমনেসিয়াম চত্বরে ২৬ দিনব্যাপী বইমেলার উদ্বোধন করেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। তাঁর বক্তব্যেও উঠে এসেছে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে হাজারো ছাত্র-জনতার ত্যাগের কথা।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, এই বইমেলার ন্যারেটিভ (বয়ান) আলাদা হবে। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটিয়ে জুলাইয়ের ৩৬ দিনে ছাত্র–জনতা রক্ত দিয়ে বাংলাদেশ বদলে দিয়েছেন। বদলে যাওয়া ন্যারেটিভের ওপর দাঁড়িয়ে আজকের এই বইমেলা। বাংলাদেশে তো বইমেলা বায়ান্ন সাল থেকেই হচ্ছে, একুশ উদ্‌যাপন করা হচ্ছে। পাশাপাশি খুবই ছোট আঙ্গিকে প্রচারণার জন্য স্মরণিকা বের করে নিজেদের পাড়ায় পাড়ায় অনুষ্ঠান ছিল। ব্যাপকভাবে বাংলা একাডেমি অনেক পরে করেছে।

উপদেষ্টা আদিলুর রহমান আরও বলেন, আজকের যে বাস্তবতা, বদলে যাওয়া বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের যে সংগ্রাম, অন্যায়–অবিচারের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম, একটা ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম, এটার ওপরে দাঁড়িয়ে আজ বইমেলা হচ্ছে।

আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের সংগ্রামের কথা লেখার অনুরোধ জানিয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা আশা করি, এ সংগ্রামে অংশ নেওয়া সমস্ত ছাত্র ও শহীদদের কথা আপনারা লিখবেন। আমাদের প্রতিনিয়ত যেন মনে থাকে, রক্তের ওপরে দাঁড়িয়ে আমরা আজকের বাংলাদেশে আছি। আমাদের যেন প্রতিনিয়ত মনে থাকে, যে ঐক্য রচিত হয়েছিল ৫ আগস্ট, সে ঐক্য যেন কোনো অবস্থাতেই কোনো শক্তি ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা না করতে পারে। আমাদের যেন এ কথা মনে থাকে, যেকোনো দুর্বলতার সুযোগে ফ্যাসিবাদ ফিরে আসার চেষ্টা করতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আগ্রাসন ও বিভিন্ন ধরনের আক্রমণের থেকে কিন্তু আমরা মুক্ত নই।’

বই মেলা উদ্বোধন করা হলেও এখনো তৈরি হয়নি অনেক স্টল। আজ বিকেল ৫টায় চট্টগ্রাম নগরের জিমনেশিয়াম মাঠে
ছবি: সৌরভ দাশ

ছাত্র-জনতার ঐক্য যাতে কেউ ভেস্তে দিতে না পারে, তা উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, ‘জনতার ঐক্য, ছাত্রসমাজের ঐক্য, গণমানুষের ঐক্য বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশ যেটা আশা করে, সেটা হচ্ছে, মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো। একুশ মানে মাথা নত না করা। আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি এবার যেন সেটা মনে রেখেই করা হয়।’

আলোচনা পর্বে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র শাহাদাত হোসেন। বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. জিয়াউদ্দীন, চট্টগ্রামের ডিআইজি মো. আহসান হাবীব ও সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।

পুরোনো প্রাঙ্গণে মেলা, উচ্ছ্বাসের সঙ্গে রয়েছে হতাশা

গতকাল সন্ধ্যা ছয়টা। মেলা প্রাঙ্গণ থেকে ভেসে আসছিল নানা শব্দ। এর মধ্যেই চলছে স্টলের সজ্জার কাজ। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বাঁশ, কাঠসহ নানা উপকরণ। এসব মাড়িয়ে কোনো রকমে হেঁটে চলছেন দর্শনার্থীরা। ঘুরছেন এই স্টল থেকে ওই স্টলে। তবে অধিকাংশ স্টলের সাজসজ্জার কাজ শেষ হয়নি তখনো।

এক বছর পর পুরোনো প্রাঙ্গণ জিমনেসিয়াম চত্বরে ফিরেছে মেলার আয়োজন। এ নিয়ে পাঠক–প্রকাশকদের উচ্ছ্বাস আছে। প্রত্যাশা, মেলা এবার অনেক বেশি জমজমাট হবে। গত বছর সিআরবির শিরীষতলায় অনুষ্ঠিত হয় মেলা। কিন্তু মেলা প্রাঙ্গণে যাতায়াত নিয়ে পাঠক–প্রকাশকদের অস্বস্তি ছিল। নিরাপত্তা নিয়েও মাসজুড়ে তাঁদের চিন্তায় থাকতে হয়েছিল। এম এ আজিজ স্টেডিয়ামসংলগ্ন জিমনেসিয়াম চত্বরে এসবের ঝামেলা নেই। তবে প্রথম দিনের চিত্র কিছুটা হতাশ করেছে তাঁদের।

কলেজশিক্ষক আলী আজগর চৌধুরী সাপ্তাহিক ছুটিতে কর্মস্থল ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এসেছেন। ঢাকায় ফিরে যাওয়ার আগে মেলায় ঘুরতে আসেন। তিনি বলেন, ‘মনে করেছিলাম সবকিছু গোছানো থাকবে। স্টলগুলোতে নতুন আসা বই সাজানো থাকবে। সেখান থেকে বাছাই করা বই কেনার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু এর কিছুই ছিল না মেলা প্রাঙ্গণে।’

বইয়ের খোঁজে এসেছে নানা বয়সের পাঠক। আজ বিকেল ৫টায় চট্টগ্রাম নগরের জিমনেশিয়াম মাঠে
ছবি: সৌরভ দাশ

আরেকজন চাকরিজীবী নওশাদ করিম। তিনি এসেছিলেন স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে। তবে কিছুটা হতাশ হয়েছেন প্রথম দিনের প্রস্তুতি নিয়ে। তিনি বলেন, সাপ্তাহিক ছুটি, তাই অন্য কোথাও ঘুরতে না গিয়ে বাবা-মেয়ে মেলায় চলে আসেন। কিন্তু স্টলগুলো এখনো প্রস্তুত হয়নি। প্রায় সব স্টলের সামনেই কাজ চলছে। রাখা হয়েছে বাঁশ, কাঠসহ নানা ধরনের যন্ত্রপাতি। মেলায় নির্বিঘ্নে ঘোরার সুযোগও নেই।

এক বছর পর আবার পুরোনো জায়গায় মেলা ফেরায় স্বস্তি ও উচ্ছ্বাস দুটিই আছে প্রকাশনাপ্রতিষ্ঠানের কর্তাদের মধ্যে। আপন আলোর প্রকাশক শামসুদ্দিন শিশির বলেন, সিআরবি থেকে জিমনেসিয়াম চত্বরে মেলা ফেরায় তাঁরা খুব খুশি। এতে পাঠক ও প্রকাশকের উপস্থিতি বাড়বে। মেলার প্রাণই হচ্ছেন পাঠকেরা। গতবার তাঁদের অনেকে সিআরবিতে যেতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন।

প্রথমা স্টলের শাওন রায় বলেন, মেলায় এবার প্রথমা প্রকাশনের অনেকগুলো নতুন বই আসবে। প্রতিবছরই প্রথমার স্টল নিয়ে পাঠকদের অনেক বেশি আগ্রহ থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না।

খড়িমাটির মনিরুল মনির। তিনি বলেন, মেলার স্থান পরিবর্তন হওয়ায় এবার মেলা আগের চেয়ে বেশি জমজমাট হবে। তাঁদের প্রস্তুতিও ভালো। অক্ষরবৃত্তের রিয়াজ মোরশেদ বলেন, তিন দিন আগে স্টল বুঝে পেয়েছেন। সময় কম পাওয়ায় স্টলের সাজসজ্জার কাজ শেষ করা যায়নি। তবে আজ রাতের মধ্যে পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে যাবে স্টল।