পাখি ভালোবাসেন, তাই চাকরি ছেড়ে পাখির দোকান দিয়েছেন তিনি
ছোট্ট দোকানঘরের দেয়ালজুড়ে লম্বা তাক। তাকের ওপর লোহার খাঁচায় নানা রঙের পাখি। বাজরিগার, লাভবার্ড, ককাটেল, গোল্ডেন পেইন, রেইনবো, প্রিন্স, প্যারেটসহ নানা পাখি। পাখিগুলো অনবরত কিচিরমিচির শব্দ করছে। দোকানে আসা দর্শনার্থীদের কেউ তা দেখছেন, কেউবা মুঠোফোনে ছবি তুলছেন।
দোকানের এক পাশে চেয়ারে বসে সেসব দৃশ্য দেখছিলেন মাসুদুল কাদির (৩০)। তিনি দোকানটির মালিক। ক্রেতা বা দর্শনার্থীরা কিছু জানতে চাইলে তিনি চেয়ার থেকে উঠে আসছেন, কথা বলছেন। ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী কখনো পাখির খাঁচাগুলো নামিয়ে দেখাচ্ছেন, কখনো দর্শনার্থীর অনুরোধে মুঠোফোনে ছবি তুলে দিচ্ছেন, কখনোবা নিজেই খেলছেন পাখির সঙ্গে। মাসুদুল, পাখি আর ক্রেতার উপস্থিতিতে বেশ জমজমাট পুরো দোকান।
গাজীপুর নগরের রাজবাড়ী ঢাল থেকে রথখোলার দিকে যেতে হাতের ডানে তাকালেই চোখে পড়বে দোকানটি। নাম দেওয়া হয়েছে গাজীপুর বার্ড হাউজ অ্যান্ড অ্যাকুরিয়াম। সম্প্রতি এক দুপুরে দোকানটিতে গিয়ে এমন পরিবেশ দেখা যায়। কাজের ফাঁকে কথা হয় মাসুদুলের সঙ্গে। আলাপে আলাপে জানান ছাত্রজীবন থেকে পাখির প্রতি তাঁর ভালোবাসা এবং সেখান থেকে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার গল্প।
মাসুদুল কাদির প্রথম আলোকে বলেন, পাখির সঙ্গে তাঁর সখ্য ছোটবেলা থেকেই। বয়স যখন চার কি পাঁচ বছর, তখন নানি শখের বশে এক জোড়া কবুতর কিনে দেন তাঁকে। কবুতর দুটি পুষে বড় করে তোলেন মাসুদুল। একসময় সেগুলো বাচ্চা দেয়। সেখান থেকে বড় হয় কবুতরের পাল। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে মাসুদুলের আগ্রহ। এর মধ্যে কিছু টাকা জমিয়ে কেনেন বিদেশি পাখি। এরপর সেখান থেকেই ধীরে ধীরে বড় হয় তাঁর পাখির সংগ্রহশালা। এরপর বয়স বাড়ার সঙ্গে চলে পাখি পালন ও পড়াশোনা।
মাসুদুল কাদির পড়াশোনা শেষ করেছেন প্রকৌশল বিষয়ের ওপর। ২০১৭ সালে রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি পাস করেন তিনি। পড়াশোনা শেষে পরিবারের ইচ্ছায় কিছুদিন একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। তবে পাখির প্রতি দুর্নিবার টানে চাকরি ছেড়ে এই দোকান দেওয়ার ভাবনা আসে তাঁর। বতর্মানে এই দোকানই তাঁর আয়ের উৎস। টাকা উপার্জনের পাশাপাশি সময় কাটান প্রিয় পাখিদের সঙ্গে।
মাসুদুল বলছিলেন, ‘ছোটবেলায় নানির দেওয়া সেই কবুতর থেকে পাখি পালনের প্রতি যে ভালো লাগা তৈরি হয়েছে, তা ছাড়তে পারিনি কখনো। পড়াশোনা শেষ করার পর পরিবার আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায়। বারবার তাগাদা দেয় চাকরির জন্য। কিন্তু আমার কিছুতেই মন বসেনি। পরে নিজ থেকেই দোকান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এখন ব্যবসার পাশাপাশি পাখিগুলোর কাছে থাকার সুযোগ পাচ্ছি।’
মাসুদুল কাদিরের বাসা নগরের মাড়িয়ালী এলাকায়। পরিবার নিয়ে থাকেন সেখানেই। প্রতিদিন সকাল নয়টায় দোকানে আসেন তিনি। থাকেন রাত ১০টা-১১টা পর্যন্ত। তাঁর দোকানে আছে বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য পাখি। দোকানে আসার পর থেকে তিনি নিজেই পাখিগুলোর দেখভাল করেন। পাখিগুলোকে খাওয়ান।
মাসুদুলের ভাষ্য, ‘চাকরিতে গেলে মাস শেষে আমি টাকা পেতাম ঠিকই, কিন্তু মনের যে আনন্দ, তা পেতাম না কিছুতেই। যে কাজে মনের আনন্দ নেই, কাজের প্রতি নেশা থাকবে না, সে কাজ করে শান্তি নেই। পাখির প্রতি আমার টান সেই ছোটবেলা থেকে। পাখি পালা আমার কাছে অনেকটা নেশার মতো। সে জন্য অন্য কিছু না ভেবে পাখির ব্যবসায় নামি। এই যে দোকানে সারা দিন পাখির শব্দ, কিচিরমিচির ডাক বা ক্রেতাদের সমাগম; এসব আমার ভালো লাগে। মনকে আনন্দ দেয়।’