ছেলে হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন মা

মেঘনায় জলদস্যুদের গুলিতে নিহত ছেলের খুনের বিচার চাইতে এসে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন মা জরিনা খাতুন। আজ দুপুরে নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদের সামনে
ছবি: প্রথম আলো।

‘আঁর রাজু কই। নির্বাচনে (গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন) কেফাইত্তার ভোট না করায় হেতে নদীতে আঁর ছেলের উফর শোধ নিছে। আঁর বুকের মানিককে কেফাইত্তা মারি হালাইছে। আঁই আর বুকের মানিক রাজুরে ছাড়া কীভাবে বাঁচুম। বাড়ি গেলে কে আঁরে মা বলি ডাইকব।’

মেঘনায় জলদস্যুদের গুলিতে দেলোয়ার হোসেন ওরফে রাজু (১৬) হত্যার বিচার চাইতে এসে এভাবে আহাজারি করতে করতে একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তার মা জরিনা খাতুন (৪৫)। আজ রোববার দুপুর ১২টার দিকে নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদের সামনে এ ঘটনা ঘটে। জলদস্যুদের গুলিতে ছেলে দেলোয়ারসহ তিন জেলের খুনের বিচারের দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে এসেছিলেন জরিনা খাতুন। জ্ঞান হারিয়ে ফেলার পর উপস্থিত লোকজন তাঁকে ধরাধরি করে একটি বেঞ্চে শুইয়ে দেন। সমাবেশ শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন।

উপজেলা পরিষদের সামনে আজ এই বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচির আয়োজন করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সকাল থেকে নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা ছাড়াও মোহাম্মদপুর ও পূর্ব চরবাটা ইউনিয়নের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ উপজেলা পরিষদ চত্বরে জড়ো হতে থাকেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তাঁরা বিচারের দাবিসংবলিত ব্যানার, পোস্টার নিয়ে প্রথমে উপজেলা পরিষদের সামনে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ও মানববন্ধন করেন। পরে ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা চর জব্বর থানার জিরো পয়েন্টে সোনাপুর-চর জব্বর-চেয়ারম্যানঘাট সড়ক অবরোধ করেন।  

এ সময় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হুমায়ুন কবির অবরোধস্থলে গিয়ে এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত সময়ের মধ্যে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দিলে তাঁরা অবরোধ তুলে নেন।

মানববন্ধনে অংশ নেওয়া নিহত তিন জেলের আত্মীয়স্বজন ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বুধবার সুবর্ণচর উপজেলার ভূঁইয়ারহাট এলাকার ইলিশ মাছের খোপে (নদীতে জেলেদের চিহ্নিত করা মাছ ধরার স্থান) মাছ ধরতে যান মাইন উদ্দিন, অলি মাঝিসহ একদল জেলে। খোপটি প্রায় ১০ বছর ধরে আলাউদ্দিনের দখলে রয়েছে। কিছুদিন ধরে মাছ শিকারের ওই খোপ দখলের চেষ্টা করছে জলদস্যু কেফায়েত বাহিনী। মেঘনার সন্দ্বীপ চ্যানেল এলাকায় জেলেদের কাছে কেফায়েত বাহিনী এক আতঙ্কের নাম।

বিক্ষোভ কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী। তিনি বলেন, তিনজন জলজ্যান্ত মানুষকে এমন নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, এটা ভাবাই যায় না। যারা এই ঘটনায় জড়িত, তাদের অবিলম্বে আইনের আওতায় আনা প্রশাসনের দায়িত্ব। জনগণের সঙ্গে তিনিও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

মানববন্ধন ও বিক্ষোভ চলাকালে ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারকে সহায়তার আশ্বাস দেন সুবর্ণচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আল আমিন সরকার।

উল্লেখ্য, গত বুধবার বিকেলে মেঘনা নদীর সন্দ্বীপ চ্যানেলের কাছে ইলিশ মাছের খোপে মাছ ধরার সময় জেলেদের ওপর হামলা চালান জলদস্যু কেফায়েত বাহিনীর সদস্যরা। এ সময় তাঁরা জেলেদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়েন এবং পিটিয়ে আহত করেন। এতে ৬ জন গুলিবিদ্ধ ও কমপক্ষে ১০ জন আহত হন। গুলিবিদ্ধদের মধ্যে সুবর্ণচরের পূর্ব চরবাটা ইউনিয়নের পূর্ব চর মজিদ গ্রামের আবদুর রহমান (৩৩) ও একই গ্রামের দেলোয়ার হোসেনকে (১৬) বুধবার রাতে সন্দ্বীপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। অপর গুলিবিদ্ধ মো. ইসমাইল হোসেন (৩০) গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। নিহত ইসমাইল একই উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের চর আলাউদ্দিন গ্রামের বাসিন্দা। এ ঘটনায় কোস্টগার্ড বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে সন্দ্বীপ থানায় একটি মামলা করে।

জেলেদের ওপর হামলার অভিযোগের বিষয়ে জানতে একাধিকবার কেফায়েত বাহিনীর প্রধান কেফায়েত উল্যার মুঠোফোনে কল করা হলেও তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ঘটনার পরপরই কেফায়েত উল্যাহ আত্মগোপন করেছেন।