রংপুরের তারাগঞ্জে রূপলাল দাস ও প্রদীপ লালকে হত্যার ঘটনায় করা মামলার এজাহারের সঙ্গে ঘটনার মিল নেই। পুলিশ নিজের মতো করে মামলা লিখে রূপলালের বাড়িতে গিয়ে তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে সই নিয়েছে বলে স্বজনদের অভিযোগ।
রূপলালের ছেলে জয়দাস বলেন, তাঁর বাবাকে যখন মারা হয়, তখন পুলিশ ঘটনাস্থলে ছিল। কিন্তু সে কথা মামলায় লেখেনি। মামলায় লেখেছে, পুলিশ নাকি তাঁকে হাসপাতালে দেখছে! তাঁর অভিযোগ, ‘এই মামলা ওরা (পুলিশ) নিজে নিজে থানায় মনমতো লেখে আমার মার সাইন নিছে। আমার বাবার গায়ে দোষ দিয়া মামলা লেখছে। পুলিশ কোনো পদক্ষেপে নিচ্ছে না। আমরা বিচার পাব, নাকি পাব না?’
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ৯ আগস্ট রাতে মিঠাপুকুরের ছড়ান বালুয়া এলাকা থেকে প্রদীপ লাল ও রূপলাল ভ্যান নিয়ে তারাগঞ্জের ঘনিরামপুর গ্রামে রূপলালের বাড়িতে আসছিলেন। ওই দিন রাত সাড়ে আটটার দিকে সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট বটতলা মোড়ে পৌঁছালে তাঁদের সন্দেহ করে ওই এলাকার লোকজন তাঁদের ভ্যান দাঁড় করান। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে রূপলাল ও প্রদীপের সঙ্গে থাকা ব্যাগ তল্লাশি করে স্পিড ক্যানের বোতলে দুর্গন্ধযুক্ত পানীয় ও কিছু ওষুধ পান।
মামলাতে ভারতী রানীর বরাতে উল্লেখ করা হয়, তাঁর স্বামী রূপলাল ও জামাতা প্রদীপের সঙ্গে থাকা ব্যাগের ভেতরে স্পিড ক্যানের বোতল খুললে মেহেদী হাসানসহ তাৎক্ষণিক কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন উত্তেজিত জনতা তাঁদের রাত ৯টার দিকে বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে নিয়ে গিয়ে লাঠি ও লোহার রড দিয়ে মারধর করেন। একপর্যায়ে তাঁদের দুই কান দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। তাঁদের তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করালে চিকিৎসক রূপলালকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রদীপকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পাঠান।
মামলা কি পুলিশ করে না বাদী করে? অভিযোগটা কে দেয়? বাদী তো সব সময় এই কথাই বলে, এটা তো স্বাভাবিক। এইটা কোনো কথা হইল?
বুড়িরহাট থেকে রূপলাল ও প্রদীপকে উদ্ধার করা হলেও পুলিশ মামলায় বলেছে, ঘটনার খবর পেয়ে তারাগঞ্জ থানা–পুলিশ দ্রুত তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উপস্থিত হয়ে রূপলালের মৃতদেহ দেখে সুরতহাল করেন। স্থানীয় লোকজনের সাক্ষ্য নেন। পরে তারাগঞ্জ থানার পুলিশ রূপলালের মরদেহের ময়নাতদন্তের জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।
কিন্তু নিহত ব্যক্তিদের স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, বটতলায় রূপলাল ও প্রদীপকে আটকের পর কয়েকজন মব তৈরি করে সেখানে এক দফা মারধর করেন। সেখান থেকে মারতে মারতে বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে নিয়ে যান। সেখানেও তাঁদের ঘিরে ধরে মারধর করা হয়। এ সময় খবর পেয়ে তারাগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জোয়ায়ের নেতৃত্ব একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। তবে রূপলাল ও প্রদীপকে উদ্ধার না করে চলে যায়। তখন রূপলাল ও প্রদীপ জীবিত ছিলেন। এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ চলে যাওয়ার এক ঘণ্টা পর সেনাবাহিনী ও পুলিশের তিনটি গাড়ি সেখানে যায়। তারা বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয় মাঠ থেকে অচেতন অবস্থায় তাঁদের উদ্ধার করে। তারাগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলেও পরীক্ষা করে চিকিৎসক রূপলালকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রদীপকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলে কয়েক ঘণ্টা পর সেখানে তিনি মারা যান।
মামলার বিষয়ে আমার মা কিছু জানেন না। ওরা নিজেরাই মামলা লেখছে, নিজেরা এসে সই নিয়ে গেছে। কাগজ সব ভুলভাল লিখে রাখছে।
ঘনিরামপুর গ্রামের ময়েজ উদ্দিন বলেন, ‘বুড়িরহাটে মারামারি ওটে রূপলালের কাম শেষ। পুলিশেরাও ওটে ছিল। পুলিশে লাশ বুড়িরহাট থাকি হাসপাতাল আনছে।’
ঘনিরামপুর গ্রামের নজরুল ইসলাম বলেন, ‘রূপলাল ভালো ছেলে ছিলেন। তিনি বাজারে কাজ করতেন। তাঁকে সবাই চেনেন। ১৫ থেকে ২০ জন লোক তাঁকে হত্যা করলেও ৭০০ জন আসামি করা হয়েছে। মামলা দুর্বল করার জন্য ৭০০ আসামি করা হয়েছে।
লাশ উদ্ধারের সময় পুলিশের সঙ্গে ছিলেন রূপলালের মেয়ে নুপুর রানী। তিনি বলেন, বুড়িরহাট স্কুল মাঠে তাঁর বাবা ও দাদা পড়ে ছিলেন। পুলিশ ও সেনাবাহিনী সেখান থেকে তাঁদের লাশ হাসপাতালে নিয়ে আসে। অথচ মামলায় লেখা হয়েছে, ওরা বাবার লাশ হাসপাতালে পেয়েছে। এটা তো সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। তাঁর দাবি, ‘মামলার বিষয়ে আমার মা কিছু জানেন না। ওরা নিজেরাই মামলা লেখছে, নিজেরা এসে সই নিয়ে গেছে। কাগজ সব ভুলভাল লিখে রাখছে।’
মামলা দুর্বল করার জন্য ৭০০ আসামি করা হয়েছে।
রূপলালের স্ত্রী ভারতী রানী অভিযোগ করেন, ‘যখন মারা গেইছে তারপর থানা থাকি লোক আসছে। কাগজ নিয়া আসি আমার কাছ থাকি সাইন নিয়া গেইছে। কিন্তু কাগজে কি লেখা আছে, আমি সেটা জানি না। পরে শুনি আমি বাদি, আমি মামলা করছি।’
মামলার বিষয়ে তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম এ ফারুক বলেন, ‘মামলা কি পুলিশ করে না বাদী করে? অভিযোগটা কে দেয়? বাদী তো সব সময় এই কথাই বলে, এটা তো স্বাভাবিক। এইটা কোনো কথা হইল? মামলায় আসামি যতই করুক, প্রকৃত আসামির ছাড় পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’