চোখজুড়ানো আমনের সবুজ খেত। গত সোমবার মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওরপাড়ের পাড়াশিমইল মাঠে
ছবি: প্রথম আলো

হাওরপারের মানুষের সারা বছরের চাহিদা পূরণ হয় বোরো ধান আবাদের মাধ্যমে। হাওরপাড়ের প্রধান শস্য এই বোরো ধান। নিচু জমিতে আমন ধানের চাষ করার চিন্তাও অনেকের মাথায় আসে না। তবে এবার পরিস্থিতি পাল্টেছে। মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরাঞ্চলে রোপা আমন ধান চাষ করেছেন অনেকে।

হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটি মৌলভীবাজার সদর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক রাজন আহমদ বলেন, এ বছর হাওরে পানি কম থাকায় অনেক নিচু জায়গায়ও আমন ধানের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে অনেক জায়গায় আগে কোনো দিন আমন চাষ হয়নি। এখন পর্যন্ত রোগবালাই তেমন একটা আসেনি। ফসল খুব ভালো হয়েছে।

গত সোমবার কাউয়াদীঘি হাওরপাড়ের সদর ও রাজনগর উপজেলার অন্তেহরি, কাদিপুর, জগৎপুর, পাড়াশিমইল, বড়কাপন, খৈশাউড়া, কুবজারসহ বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, যত দূর চোখ যায় সবুজ।

সব আমনের খেত। অন্য বছর এ সময় জমিগুলোতে পানিতে ভরপুর থাকত। সবুজের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে দুই-একটি স্থানে হঠাৎ লালচে ধানখেত দেখা গেছে। দূর থেকে পাকা ধান মনে হয়। তবে তা পাকা নয়। সময়মতো বৃষ্টি না পেয়ে ধানে এই লালচে রং ধরেছে। বৃষ্টি হলে তা আর থাকে না। আবার খেত সবুজ হয়ে যায়।

হাওরপারের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাউয়াদীঘি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার দুটি ইউনিয়ন এবং রাজনগর উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে বিস্তৃত। বর্ষাকালে হাওরে পানির স্তর ১৫ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত উঠে থাকে। বৈশাখ মাস থেকেই পানি বাড়া শুরু হয়। আশ্বিন-কার্তিক পর্যন্ত হাওরে পানি থাকে। কিন্তু এবার হাওরে পানি এসেছে দেরিতে। মৌসুমি বৃষ্টি সময়মতো না হওয়ায় আষাঢ় মাসে হাওরে পানি কম ছিল। বিলম্বে পানি আসায় হাওরের জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব পড়েছে। অন্য বছরের মতো মাছের দেখা মিলছে না। শাপলা-শালুকসহ জলজ লতাপাতাও কম।

তবে পানি কম থাকার এই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছেন কৃষকেরা। অন্য বছর হাওরপারের এসব জমিতে আমন ধানের চাষ করতে কৃষকদের অনেক ভাবনাচিন্তা করতে হয়েছে। কখন হাওরে পানি বেড়ে রোপণ করা ধান পানিতে তলিয়ে যায়—এ আশঙ্কায় থাকতেন। অনেক সময় কাউয়াদীঘি হাওরের কাশিমপুরে স্থাপিত সেচ পাম্পের মাধ্যমে বৃদ্ধি পাওয়া পানি বের করার জন্য কৃষকদের আন্দোলন-সংগ্রামও করতে হয়। কিন্তু এবার হাওরপারের জমিতে আমন চাষের অনুকূল পরিবেশ পেয়েছেন।

রাজনগর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের কাউয়াদীঘি হাওরপারের অন্তেহরি গ্রামের গৌরা দেবনাথ (৪৫) বলেন, ‘আমি তিন কিয়ার (বিঘা) খেত (চাষ) করছি। আমরা যে যত খেতই করছি, এতাত (এই জমিতে) জীবনেও আমন খেত অইছে না (হয়নি)। মাইনসে (মানুষ) দুই কিয়ার, তিন কিয়ার যে যা পারছে, করছে। যেই রোয়া মারছে (রোপণ করছে), তার ধান অইছে (হয়েছে)। আমরার এই খেতও (জমিতে) কোনো দিনই আগন মাইয়া ধান অয় না (অগ্রহায়ণ মাসের ধান হয় না)।’

পাঁচগাঁও ইউপির চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম গত সোমবার বলেন, এবার হাওরে পানি কম হয়েছে। ফলে আমন ধানের খেত করা গেছে। ফলন এখন পর্যন্ত ভালো। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে মূল জমিতে রোপা আমন রোপণ করা হয় এবং অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে এ ধান কাটা হয়। আবহাওয়া এ রকম থাকলে কৃষকেরা লাভবান হবেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর কাউয়াদীঘি হাওরাঞ্চলের প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমিতে আমনের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১০০ হেক্টর জমি আছে, যেগুলোতে শুধু বোরো ফসল ফলে।

পানি কম হওয়ায় এবার সেসব জমিতেও আমনের চাষ হয়েছে। পুরো জেলায় ১ লাখ ২ হাজার ১৮০ হেক্টর জমিতে আমনের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে আছে ব্রি ধান-৮৭, ৪৯, ৯২, ৭৫, বিনা-১৭, স্বর্ণা, রণজিৎ ইত্যাদি জাতের ধান।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজারের উপপরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কাউয়াদীঘি হাওরাঞ্চলে দেড় হাজার হেক্টরের মতো জমিতে আমনের চাষ হয়েছে। সাধারণত এসব জমিতে আমন চাষ হতো না, পানি থাকত। এমন জমিতেও আমনের চাষ হয়েছে।’