ভোলায় ঘরচাপায় বৃদ্ধের মৃত্যু, রাতভর চরাঞ্চলে আতঙ্ক

আজ সকাল আটটা পর্যন্ত ভোলার বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টি ও দমকা হাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ছবিটি গতকাল রোববার ইলিশা ফেরি ও লঞ্চঘাট এলাকা থেকে তোলাছবি: প্রথম আলো

ভোলার লালমোহন উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ঘর চাপা পড়ে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। তবে তাঁর নাম-পরিচয় জানা যায়নি। এদিকে গতকাল রোববারের ঝড়, বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হওয়ার আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে ভোলার উপকূলীয় এলাকার লক্ষাধিক মানুষ। ঘূর্ণিঝড়ে এ পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকায় তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেল।

ভোলার ত্রাণ কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা লালমোহন উপজেলায় একজনের ঘরচাপায় নিহত হওয়ার খবর পেয়েছি। তবে বিস্তারিত জানতে পারিনি। সব উপজেলায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে লোক লাগানো হয়েছে। আশা করি, শিগগিরই বিস্তারিত জানাতে পারব।’

এর আগে গতকাল রাত সাড়ে নয়টায় আবহাওয়া অধিদপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে দুজনের মৃত্যুর তথ্য জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান।

এর আগে গতকাল রাত সাড়ে নয়টায় আবহাওয়া অধিদপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে দুজনের মৃত্যুর তথ্য জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান।

এদিকে ভোলার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, গতকাল দিনের চেয়ে রাতে ঝড়বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বেশি হয়েছে। আজ সোমবার সকাল আটটা পর্যন্ত সমানে বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া চলমান ছিল।

আতঙ্কে গতকাল রাতে ঘুমাতে পারেননি জানিয়ে ভোলার লালমোহন উপজেলার চর শাহাজালালের বাসিন্দা মো. নাসিম মাঝি (৪৫) বলেন, ‘রাতের জোয়ারে ঘরে প্রায় খাটসমান পানি উঠে যায়। রাত আটটার দিকে জোয়ার আসে। সেই জোয়ার নামে ভোরে ফজরের আজান দেওয়ার পর। সারা রাত আতঙ্কে ছিলাম, ভেবেছিলাম পানি আরও বাড়বে। ভয়ে ছিলাম সাপ-বিচ্ছুর আর ঝড়ে ঘর বিধ্বস্ত হওয়ার। সারা রাত ঘুম আসেনি।’

আরও পড়ুন

সাইক্লোন সেল্টারে আশ্রয় কেন নেননি, তা জানতে চাইলে নাসিম বলেন, চরশাহাজালাল তেঁতুলিয়া নদীর মধ্যে জেগে ওঠা একটি চর। সেখানে ৭৩টি পরিবারের বসবাস। কিন্তু কোনো সাইক্লোন সেল্টার নেই। পানি বাড়লে তাঁরা ট্রলারে পাশে বনের মধ্যে চলে যান। সেখানে গাছের সঙ্গে ট্রলার বেঁধে পানি কমার অপেক্ষা করেন।

গত রাতে ঘুমাতে পারেননি ভোলার মনপুরা উপজেলার দুর্গম কলাতলী ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. মোসলেহ উদ্দিনও। তিনি বলেন, গতকাল দিন ও রাতের জোয়ারে ঘরে গলাসমান পানি উঠেছে। ঘরের খাটের ওপর দাঁড়ানোর অবস্থা ছিল না। বাড়ির আশপাশের সব ফসল লোনাপানিতে ডুবে গেছে। তাঁর দুটি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। ঘরের ভেতরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁদের বাড়ির আশপাশে সাইক্লোন সেল্টার না থাকায় তাঁরা ঘরের মাচার ওপর আশ্রয় নেন। আর আশপাশের বাসিন্দাদের অনেকেই আশ্রয়ের সন্ধানে যান অফিসখাল বাজারে। সেখানে কয়েকটি পাকা দোকানে আশ্রয় নেন তাঁরা।

এ বিষয়ে কলাতলী ইউনিয়নের পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আলাউদ্দিন হাওলাদার বলেন, তাঁর ইউনিয়নের চারপাশে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণে কোনো বাঁধ না থাকায় অবাধে পানি উঠে কৃষকের ফসল, পুকুরের মাছ, ঘরের ভিত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর এসব পানি লবণাক্ত হাওয়ায় পানি নেমে গেলেও সব পচে নষ্ট হয়ে যায়।

মনপুরায় ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য গেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। মনপুরা, লালমোহন, তজুমদ্দিন ও চরফ্যাশন উপজেলায় মোট ১০টি স্থানে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
হাসান মাহমুদ, পাউবো ডিভিশন-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মনপুরা উপজেলার কলাতলী, কাজিরচর ও হাজিরহাট ইউনিয়নের সোনারচর, চরযতিন, সোনারচর, চরফৈজুদ্দিন ও মনপুরা ইউনিয়নের পূর্ব আন্দিরপাড় ও রামনেওয়াজ লঞ্চঘাট এলাকা কুমিরখালীসহ দুর্গম ও নিম্নাঞ্চল জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। জোয়ারের তোড়ে উপজেলাটির প্রায় চার কিলোমিটারের একটি বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া আরও একাধিক বেড়িবাঁধ ভাঙার খবর পাওয়া গেছে। জোয়ারের পানির তোড়ে এসব চরাঞ্চলের শতাধিক ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে।

মনপুরা উপজেলা হাজিরহাটের ইউপি চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন হাওলাদার জানান, হাজিরহাটের পূর্ব পাশে চার কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (পাউবো) বস্তা ও জিও ব্যাগ ফেলে বাঁধ রক্ষার জন্য বলা হয়েছে।

পাউবো ডিভিশন-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ জানান, মনপুরায় ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য গেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। প্রকৌশলী আরও জানান, মনপুরা, লালমোহন, তজুমদ্দিন ও চরফ্যাশন উপজেলায় মোট ১০টি স্থানে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ভোলার দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গতকাল দিনের জোয়ারের চেয়ে রাতের জোয়ারের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় মানুষের উঠানে পানি উঠেছে। চর কুকরি-মুকরি ইউনিয়নের সিপিপি টিম লিডার মো. শাহজাহান খোকন জানান, ইউনিয়নের চরপাতিলা এলাকা ছয় থেকে সাত ফুট পানিতে প্লাবিত হয়ে প্রায় সাত হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। চরপাতিলায় পর্যাপ্ত সাইক্লোন সেল্টার নেই। যে যেখানে পারছে আশ্রয় নিয়েছে, কেউ কেউ নিজ ঘরের মাচায় আশ্রয় নিয়েছে।

চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর ইউনিয়নের ঢালচর ও চরনিজামে বন্যা-জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নেই। এ কারণে বাসিন্দারা ঘর ছেড়ে, গবাদিপশু রেখেই নিরাপদ আশ্রয়ে গেছে। ঢালচর ইউপির চেয়ারম্যান মো. আবদুস সালাম জানান, সকালের জোয়ারে ইউনিয়নের সব এলাকা পাঁচ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ওই পানি কমতে না কমতে আবার রাতের জোয়ার আসবে। এখানে প্রায় ১২ হাজার মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিতে ইউনিয়নের গ্রাম পুলিশসহ ইউপি সদস্যদের মানুষের বাড়ি বাড়ি পাঠানো হচ্ছে।

আরও পড়ুন