নবীর প্রামাণিকের ‘ভ্রাম্যমাণ সেলুন’ চলছে ৩৫ বছর ধরে

খোলা আকাশের নিচে পিঁড়িতে বসিয়ে চুল কাটছেন নবীর প্রামাণিক। সম্প্রতি পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার তালপট্টি বাজারে
ছবি: প্রথম আলো

পিঁড়িতে বসে মাথা নিচু করে আছে এক কিশোর। সামনে পায়ের ওপর ভর দিয়ে তার চুল কাটছেন এক ব্যক্তি। চুল ও দাড়ি কাটানোর জন্য আরও দুজন রয়েছেন অপেক্ষায়। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ওই কিশোরের বাবা মুকুল হোসেন। তিনি বললেন, ‘নবীর ভাই (নবীর প্রামাণিক) ফুটপাতের নাপিত হলেও তাঁর কাজ খুব ভালো। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে হাটে এসে তাঁর কাছে চুল কাটাতাম। এখন আমি ছেলেকে এনে চুল কাটাই।’

সম্প্রতি পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার তালপট্টি হাটে গিয়ে এ চিত্র দেখা যায়। দুই দশক আগেও দেশের বিভিন্ন হাটবাজার ও প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে নবীর হোসেনের মতো ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরদের চোখে পড়ত। মূলত হাটবাজারে ইটের ওপর অথবা পিঁড়িতে বসিয়ে কিংবা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁরা মানুষের চুল–দাড়ি কেটে পরিপাটি করে দিতেন। বর্তমানে এমন নরসুন্দরদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। হঠাৎ প্রত্যন্ত এলাকার কোনো হাটে তাঁদের দু-একজনের দেখা মেলে। তাঁদের নির্দিষ্ট কোনো বসার জায়গা নেই। যেখানে সুযোগ পান সেখানেই চুল-দাড়ি কাটার সরঞ্জাম আর বসার ইট বা পিঁড়ি নিয়ে তাঁরা বসে পড়েন।

৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে হাটবাজারে, পথের ধারে ও বাড়িতে গিয়ে চুল-দাড়ি কাটেন নবীর প্রামাণিক। উপজেলার সাতানি গ্রামে তাঁর বাড়ি। বাবার হাত ধরে এই পেশায় আসেন তিনি। নবীর বলেন, একসময় তাঁর মতো যাঁরা ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দর হিসেবে বিভিন্ন হাটবাজারে কাজ করতেন তাঁদের প্রায় সবাই পেশা পরিবর্তন করেছেন, নয়তো আধুনিক সেলুনে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু বাপদাদার পথ অনুসরণ করে তিনি এখনো ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দর হিসেবে উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে চুল-দাড়ি কাটার সরঞ্জাম নিয়ে ঘুরে বেড়ান। অল্প খরচে যাঁরা চুল-দাড়ি কাটতে চান, মূলত তাঁরাই তাঁর ‘গ্রাহক’। হাটবাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে এসে পরিপাটি হয়ে বাড়ি ফেরেন তাঁরা।

নবীর হোসেন যেখানে যান সেখানেই গ্রাহকের অভাব হয় না। সম্প্রতি পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার তালপট্টি বাজারে
ছবি: প্রথম আলো

অল্প খরচে নবীর প্রামাণিকের কাছ থেকে চুল-দাড়ি কাটা যায়। তবে এর বাইরেও অন্য কারণে তাঁর খ্যাতি রয়েছে। আর তা হলো চুল-দাড়ি কাটায় তাঁর হাত বেশ ভালো। এতে সব মিলিয়ে যে হাটে বা বাজারে তিনি যান, গ্রাহকের অভাব হয় না তাঁর। অনেকে হাটবারের জন্য অপেক্ষায় থাকেন। কারণ, সাধারণত হাটবারে তিনি উপজেলার বিভিন্ন হাটগুলোতে চুল-দাড়ি কাটতে যান।

কথা বলে জানা যায়, নবীর প্রামাণিক চুল কাটতে ২০ টাকা ও দাড়ি কাটতে ১০ টাকা নেন। তবে কখনো কখনো খুশি হয়ে অনেকে এর চেয়ে বেশি যেমন তাঁকে দিয়ে থাকেন, তেমনি আবার কেউ কেউ কমও দেন। সব মিলিয়ে আড়াই থেকে তিন শ টাকার বেশি আয় হয় না তাঁর। এই টাকাতে চালাতে হয় ছয়জনের সংসার।

নবীর প্রামাণিকের নিয়মিত গ্রাহক তালপট্টি গ্রামের রজব আলী। তিনি বলেন, ‘কামলার কাজ করি। সেলুনে চুল ও দাড়ি কাটাব্যার গেলি কমপক্ষে ৬০ টাকা লাগে। কিন্তু এনার কাছে মাত্র ৩০ টাকাতেই চুল ও দাড়ি কাটানো যায়। সেলুনের চাইতে এনার কাজ কোনো অংশে খারাপ না।’

আক্ষেপ নিয়ে নবীর প্রামাণিক বলেন, ‘একসময় ম্যালা মানুষ হাটবাজারে ঘুইর‌্যা নাপিতের কাজ করত। কিন্তু এখন এই এলাকায় আমি ছাড়া আর তেমন কেউ নাই। হাটবাজারে কাম কইর‌্যা যে আয় হয় তাতে সংসার ঠিকমতো চলে না। সেলুনে কাজ করলি এর চাইতে আয় কিছুটা বেশি হতো।’