যশোরে বোরোর পোকা দমনে ‘পার্চিং পদ্ধতি’

ক্ষতিকর পোকা দমনে বোরো খেতে নির্দিষ্ট দূরত্বে গাছের ডাল পুঁতে রাখা হয়েছে। যশোরের অভয়নগর উপজেলার শিবনগর বিলেছবি: প্রথম আলো

কৃষক গোলাম খায়বর মোল্যা এবার ১০ বিঘা (৫২ শতকে বিঘা) জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছেন। পোকামাকড়ের হাত থেকে খেত রক্ষা করতে তিনি প্রতি আড়াই বিঘা জমির ধানখেতের মধ্যে ৪৫টি বাঁশের কঞ্চি পুঁতেছেন। খেতের মধ্যে পুঁতে রাখা ওই কঞ্চিতে পাখি এসে বসছে। পাখিগুলো খেতের ক্ষতিকর পোকামাকড় ধরে খাচ্ছে। এতে তাঁর খেতে পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হচ্ছে।

যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার ধুপখালী গ্রামে বাড়ি কৃষক গোলাম খায়বর মোল্যার। গোলাম খায়বর মোল্যার মতো যশোর জেলার অনেক কৃষক পাখি বসার উপযোগী বাঁশের আগা, কঞ্চি, বাঁশের চটার ওপরের অংশে আরেকটি ছোট চটা আড়াআড়িভাবে বেঁধে তৈরি করা খুঁটি, গাছের ডাল প্রভৃতি পুঁতে বোরো খেতে ক্ষতিকর পোকা দমন করছেন। বাড়তি খরচ আর কীটনাশকের ব্যবহার না থাকায় ক্রমে এই পদ্ধতি জনপ্রিয় হচ্ছে। পোকা দমনের এ পদ্ধতিকে বলে ‘পার্চিং পদ্ধতি’।

গোলাম খায়বর বলেন, ধানের চারা রোপণের ২০ থেকে ২৫ দিন পর থেকে খেতের মধ্যে বাঁশের কঞ্চি পুঁততে শুরু করেন। ধানে থোড় আসার আগপর্যন্ত কঞ্চি পোঁতা যায়। কঞ্চিতে প্রচুর পরিমাণে ফিঙে ও শালিক বসছে। পাখি ফড়িং ও মাজরা পোকা ধরে খাচ্ছে। ধানের ক্ষতিকর পোকা দমনে, বিশেষ করে মাজরা পোকা দমনে এই পদ্ধতি খুবই কার্যকর। এতে তাঁর খুব উপকার হচ্ছে। খেতে তেমন কোনো কীটনাশক ব্যবহার করতে হচ্ছে না।

সরকারি কৃষিবিষয়ক একটি সেবা ‌‌কৃষি তথ্য সার্ভিসের (এআইএস) তথ্যমতে, পার্চিং ইংরেজি শব্দ। এর অর্থ খেতে ডালপালা পুঁতে দেওয়া। ফসলের জমিতে ডাল, কঞ্চি, বাঁশের খুঁটি এগুলো পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করলে পাখি ক্ষতিকারক পোকার মথ, বাচ্চা, ডিম খেয়ে পোকা দমন করে। পোকা দমনের এ পদ্ধতিকে পার্চিং বলা হয়। ফসলের পোকা দমনের এ পদ্ধতি অত্যন্ত কম ব্যয়বহুল, বলতে গেলে ব্যয়বিহীন এবং পরিবেশবান্ধব।

কৃষিবিদেরা বলছেন, ক্ষতিকর পোকামাকড়, বিশেষ করে মাজরা পোকা দমনে এই পদ্ধতি বেশ কার্যকর। ধানের চারা রোপণের ২০ দিনের মধ্যে খেতে পার্চিং শুরু করা হয়। এক বিঘা জমির একটি খেতে কমপক্ষে ১০টি বাঁশের আগা, কঞ্চি বা ডাল পুঁততে হয় বলে তাঁরা জানান।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যশোর কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রতিবছর জেলায় বোরো আবাদে জমির পরিমাণ বাড়ছে। সেই সঙ্গে জেলার কৃষকদের মধ্যে পার্চিংয়ের ব্যবহারও বাড়ছে। ২০২৩ সালে বোরো মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ৬০ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরোর চাষ করা হয়। এর মধ্যে ২০ শতাংশ জমিতে পার্চিং করা হয়। চলতি মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ৬০ হাজার ৬৭৫ হেক্টর জমিতে বোরোর চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে পার্চিং করা হয়েছে; যা মোট আবাদের ২৫ শতাংশ। এখনো খেতে পার্চিং চলছে।

শার্শা উপজেলার রাঘবপুর গ্রামের কৃষক খোরশেদ আলম এবার তিন বিঘা (৩৩ শতকে বিঘা) জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছেন। তিনি সম্পূর্ণ খেতে পার্চিং করেছেন। তিনি বলেন, চারা রোপণের কয়েক দিন পর খেতে ৫০টি বাঁশের কঞ্চি পুঁতে দিয়েছেন। এই পদ্ধতি খুব ভালো। এতে খরচও কম।

অভয়নগর উপজেলার মধ্যপুর গ্রামের কৃষক ইমারুল ইসলাম এবার ৫০ শতক জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি বাঁশের চটার ওপরের অংশে আরেকটি ছোট চটা আড়াআড়িভাবে বেঁধে খুঁটি তৈরি করেছি। ৩০টি খুঁটি বোরো ধানের খেতে পুঁতে দিয়েছি। খুঁটির ওপরের দিকে আড়াআড়িভাবে বাঁধা চটার ওপর ফিঙে ও শালিক বসে খেতের ক্ষতিকর পোকা ধরে খেয়ে ফেলছে। এতে ভালো কাজ হচ্ছে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর কার্যালয়ের উপপরিচালক সুশান্ত কুমার তরফদার বলেন, ক্ষতিকর পোকা, বিশেষ করে মাজরা দমনে পার্চিং পদ্ধতি খুব কার্যকর। এই পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব। মাজরা পোকা দমনে কীটনাশক না দেওয়ায় এতে কৃষকের উৎপাদন ব্যয়ও কম হয়। ধানের ফলনও বেশি হয়। তাঁরা কৃষকদের খেতে পার্চিং করতে উৎসাহ দিচ্ছেন। এ জন্য জেলার বিভিন্ন এলাকায় কৃষকদের নিয়ে মাঠে পার্চিং উৎসব করা হচ্ছে। এ ছাড়া আইপিএম (ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট-সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা) স্কুলের মাধ্যমে কৃষকদের খেতে পার্চিং করতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।