সাগর উপকূলে নয়, তবু লবণ চাষ হয় যে উপজেলায়

লোনাপানি শুকিয়ে লবণ উৎপাদন করা হচ্ছে। সম্প্রতি পটিয়ার ইন্দ্রপুল এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে বিছানো রয়েছে পলিথিন। সেই পলিথিনে সূর্যতাপে লোনাপানি জমাট বেঁধে পরিণত হচ্ছে সাদা লবণে। কয়েকজন শ্রমিক সেই লবণ তুলে মাঠে স্তূপ করে রাখছেন। লবণ উৎপাদনে শ্রমিকদের এই ব্যস্ততা দেখা যায় চট্টগ্রামের পটিয়ায় উপজেলার ইন্দ্রপুল এলাকায়।

সাধারণত সাগর উপকূলীয় অঞ্চলে এভাবে লবণের চাষ হয়। তবে সাগর উপকূলীয় এলাকা না হয়েও পটিয়ার প্রায় ১০০ একর জমিতে চাষ হচ্ছে লবণের। পটিয়ার ইন্দ্রপুল এলাকায় রয়েছে ৪৯টি লবণ পরিশোধন কারখানা, যার মধ্যে বর্তমানে চালু রয়েছে ৩৭টি। এসব কারখানার পরিত্যক্ত লোনাপানি ব্যবহার করেই মূলত ইন্দ্রপুল এলাকায় লবণের চাষ হচ্ছে।

কারখানার মালিকদের পাশাপাশি স্থানীয় কিছু বাসিন্দা দুই দশক ধরে ইন্দ্রপুল এলাকায় লবণের চাষ করে আসছেন। কারখানার পরিত্যক্ত লোনাপানির কারণে এসব জমিতে কোনো ধরনের চাষাবাদ করা যেত না। বর্তমানে পতিত এসব জমিতে লবণ চাষ করে মৌসুমে ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা আয় হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চাষিরা।

সম্প্রতি সরেজমিনে ইন্দ্রপুল এলাকার চানখালী খালের তীরবর্তী লবণ শিল্পাঞ্চলে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কিছু জমিতে পলিথিন বিছিয়ে লবণ উৎপাদন চলছে। একটি লবণ মাঠে কথা হয় রিফাত হোসেন নামের এক শ্রমিকের সঙ্গে। বাঁশখালী উপজেলার এই বাসিন্দা বলেন, তিনিসহ ৮ জন শ্রমিক ৩০ একর জমির লবণ মাঠে কাজ করছেন। তিন বছর ধরে পটিয়ার ইন্দ্রপুল এলাকায় কাজ করছেন তিনি। প্রতি মাসে লবণশ্রমিক হিসেবে ২৫ হাজার টাকা করে পান।

পটিয়ার ইন্দ্রপুলের ইসলামাবাদ সল্টের মালিক ও লবণ মিল মালিক সমিতির সহসাধারণ সম্পাদক অহিদুছ ছমদ বলেন, ২০ বছর ধরে কারখানার পরিত্যক্ত পানি দিয়ে এলাকাটিতে লবণ চাষ হচ্ছে। তিনিও লবণ চাষের জন্য দুই এর পরিত্যক্ত জমি বর্গা দিয়েছেন। প্রতি কানি (৪০ শতক) জমির বর্গা বাবদ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়।

পটিয়া লবণ মিল মালিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও মোহাম্মদীয় সল্টের মালিক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, তাঁর কারখানার পরিত্যক্ত লবণপানি যাতে নষ্ট না হয় সে লক্ষ্যে তিনি ২০ কানি জমিতে লবণ চাষ করে আসছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে জমি নিয়ে শ্রমিক দিয়ে লবণ চাষ করছেন তিনি।

লবণ কারখানার মালিকেরা জানান, প্রতি মৌসুমে ইন্দ্রপুল এলাকার মাঠ থেকে ১৫–২০ হাজার মেট্রিক টন লবণ পাওয়া যায়। এসব লবণ বিক্রি করে কমপক্ষে পাঁচ কোটি টাকা আয় হয় চাষিদের। কখনো কখনো আয় ১০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। সাধারণত এসব লবণ বিভিন্ন শিল্পকারখানা, মৎস্য, পোলট্রি ও ডেইরি খামারে ব্যবহার হয়। তবে মানভেদে কিছু লবণে আয়োডিন যুক্ত করে খাবারের জন্য প্যাকেটজাত করা হচ্ছে।

জানা গেছে, ১৯৫২ সালের দিকে ইন্দ্রপুল এলাকায় লবণশিল্পের সূচনা হয়। চানখালী খালকে কেন্দ্র করে ইন্দ্রপুল এলাকায় লবণ পরিশোধন কারখানা গড়ে ওঠে। কারখানাগুলোতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় উৎপাদিত কাঁচা লবণ পরিশোধন করে আয়োডিন যুক্ত করা হয়। পরে তা বাজারজাত হয় খাবারের লবণ হিসেবে।

মাঠ থেকে লবণ কারখানায় নেওয়ার প্রস্তুতি
ছবি; প্রথম আলো

পটিয়া বিসিকের শিল্প কর্মকর্তা রমেশ চন্দ্র সানা বলেন, কারখানার পরিত্যক্ত পানি থেকে লবণ উৎপাদনের মাধ্যমে অনেক কারখানার মালিক বাড়তি আয় করছেন। এ ছাড়া লবণ চাষের মাধ্যমে ৭০-৮০ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে।

কারখানার মালিকেরা জানান, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক সম্প্রসারণের সময় পটিয়ার ইন্দ্রপুল এলাকার লবণ শিল্পকারখানার অনেক জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এতে শিল্পাঞ্চলটি সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় তাঁরা এই শিল্পাঞ্চল দ্রুত অন্য কোথাও স্থানান্তরের দাবি জানিয়ে আসছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিসিক কর্মকর্তা রমেশ চন্দ্র সানা বলেন, ২০২১ সালে প্রায় ৫০০ ফুট দূরে নতুন জায়গায় শিল্পাঞ্চলটি স্থানান্তরের জন্য একটি লিখিত প্রস্তাবনা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।