কুয়াশাভেজা সিআরবিতে দৌড়াল পাঁচ শতাধিক শিশু-কিশোর
কুয়াশা ভেদ করে ভোরের আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে। সড়ক তখনো কুয়াশাভেজা। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম নগরের সিআরবির শিরীষতলা যেন হঠাৎ নতুন শব্দে জেগে উঠল। শিশুদের উচ্ছ্বাস, পায়ের টুপটাপ শব্দ, উত্তেজনায় কাঁপা নিশ্বাসে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল আনন্দ। দেখা গেল, দৌড়াচ্ছে প্রায় পাঁচ শতাধিক খুদে দৌড়বিদ।
আজ শুক্রবার ভোরে সিআরবিতে খুদেদের এই ম্যারাথনের আয়োজন করে ফুলকি সহজপাঠ বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটির সুবর্ণজয়ন্তীর বর্ষ চলছে। ১৯৭৬ থেকে শুরু হওয়া এই যাত্রা এখন অর্ধশতকে পৌঁছানোর ঠিক আগমুহূর্তে দাঁড়িয়ে। আর সেই দীর্ঘ পথচলার আনন্দে আয়োজন করা হয় ‘খুদেদের ম্যারাথন’।
অনুষ্ঠানের শুরু হয় জাতীয় সংগীতে। এরপর আকাশে ওড়ে রঙিন বেলুন আর ফেস্টুন। আয়োজনের উদ্বোধন করেন এভারেস্টজয়ী পর্বতারোহী বাবর আলী, ফুলকি ট্রাস্টের সভাপতি কবি ও প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন ও সর্বাধ্যক্ষা শীলা মোমেন। আশপাশের পাহাড়ের ঢালে তখনো রোদ পুরোপুরি বসেনি। কিন্তু শিশুদের মুখে উজ্জ্বলতা ছিল সকালকে হার মানানো।
সকাল সাতটা বাজতেই সিআরবির সাতরাস্তা মোড়ে দাঁড়ায় পাঁচ শতাধিক খুদে দৌড়বিদ। বয়স অনুযায়ী তিন দূরত্ব—৫ কিলোমিটার, ২ কিলোমিটার আর ১ কিলোমিটার। যেই বাঁশি বাজল, ৫ কিলোমিটার অংশগ্রহণকারীদের সামনে পাহাড়ি রাস্তা যেন ঢেউ তুলল তাদের পায়ের শব্দে। একটু পর ছুটল ২ কিলোমিটার আর ১ কিলোমিটার দৌড়ের খুদেরা।
ম্যারাথন শেষে এল পুরস্কারের পালা। ৫ কিলোমিটার দৌড়ে ছেলেদের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হয় বর্ণময় সেনগুপ্ত, মেয়েদের মধ্যে নুসরাত জাহান। ২ কিলোমিটার দৌড়ে ছেলেদের মধ্যে মো. আরহাম হোসেন, মেয়েদের মধ্যে মানহা জাফরিন। আর ১ কিলোমিটার দৌড়ে ছেলেদের মধ্যে রাজদ্বীপ চক্রবর্তী, মেয়েদের মধ্যে নাজিয়া কাওসার।
সমাপনী মঞ্চে দাঁড়ানো প্রতিটি শিশুই তখন বিজয়ীর মতো। সবার গলায় ঝুলল মেডেল। এটি ছিল অংশগ্রহণের সাহসের স্বীকৃতি। তিন ক্যাটাগরিতে সেরা ৫ ছেলে ও ৫ মেয়েকে দেওয়া হলো ক্রেস্ট, মেডেল আর সনদ। বাবর আলী শিশুদের বললেন, ‘তোমরা দৌড়াতে নেমেছ, নিজেদের প্রমাণ করেছ। এটা যেন থেমে না যায়। অভ্যাস করে রাখো, শরীর আর মনে দৌড়ের শক্তি ধরে রাখো।’
ফুলকির সর্বাধ্যক্ষা শীলা মোমেন বলেন, জীবনের গতিও যেন এ দৌড়ের মতোই হয়। সব সময় সামনে, সব সময় চলমান। আয়োজকেরা জানালেন, চট্টগ্রামের ৩৩টি বিদ্যালয়ের শিশু-কিশোরেরা যুক্ত হয়েছিল এ আয়োজনের সঙ্গে। ছিল ফুলকি সহজপাঠ বিদ্যালয়ের শিশুরাও। সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিল ফুলকির শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। সহযোগিতায় ছিল বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ আর এসএমসি।
শিশুদের জগৎ
ফুলকি মূলত শিশুদের জগৎ। এর যাত্রা শুরু হয় মানবিক গুণের চর্চা, সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশ ও বুদ্ধিবৃত্তিক মেধার লালনকে কেন্দ্র করে। শুরু থেকেই উদ্যোগটির পাশে ছিলেন প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, বেগম উমরতুল ফজল, শিল্পী সবিহ-উল আলম, অমিত চন্দ, আবুল মোমেন ও শীলা মোমেন। পরবর্তী সময় যুক্ত হন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম ও ইতিহাসবিদ শামসুল হোসাইন। দুজনই আমৃত্যু ছিলেন ফুলকির পরামর্শদাতা ও পথপ্রদর্শক।
শিশুশিক্ষার লক্ষ্য পূরণের পথে ফুলকি ক্রমেই গড়ে তোলে দুটি মডেল প্রতিষ্ঠান—সহজপাঠ নামে প্রাথমিক স্কুল এবং সোনারতরী নামে সাংস্কৃতিক স্কুল। পাশাপাশি অন্যান্য বিদ্যালয়ের শিশুদের জন্যও সাহিত্য, সংগীত, চারুকলা, মনীষী-কথা, সভ্যতার গল্প, বিজ্ঞানচর্চা—এই সবকিছুর সমন্বয়ে একটি বিস্তৃত সাংস্কৃতিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে, যা পরিচিত সমন্বিত শিক্ষা-সংস্কৃতি কার্যক্রম নামে। আগামী বছর ফুলকি ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপন করবে।