নিহত বেড়ে ৫, হামলার ঘটনায় ৩টি মামলা করল পুলিশ

কারফিউ চলাকালে শিশুর জন্য দুধ কিনতে বের হলে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি সাগর শেখকে পুলিশ আটক করে। পরে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। গতকাল গোপালগঞ্জের পাঁচুড়িয়া মোড়েছবি: সাদ্দাম হোসেন

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ‘জুলাই পদযাত্রা’ ঘিরে দফায় দফায় হামলা–সংঘর্ষের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে পাঁচজন হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে রমজান মুন্সি নামের ওই ব্যক্তি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। পুলিশের ওপর হামলা, গাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে জড়ানোর অভিযোগে তিনটি মামলা হয়েছে।

গত দুই দিনে সদর, কাশিয়ানী ও কোটালীপাড়া থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলাগুলো করে। নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি নিউটন মোল্লা, সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমানসহ ১৫৭ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হয়। এসব মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও ২ হাজার ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ঘটনায় গত বুধবার থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ১৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

বুধবার এনসিপির কর্মসূচি ঘিরে আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা হামলা চালান। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে নেতা-কর্মীদের সংঘাত বাধে। এ সময় গুলিতে চারজন নিহত ও অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। এ ঘটনায় আহত রমজান মুন্সি বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত পৌনে দুইটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি পেশায় রিকশাচালক ছিলেন। রমজান মুন্সি গোপালগঞ্জ শহরের থানাপাড়া এলাকার আকবর মুন্সির ছেলে।

রমজান মুন্সির বড় ভাই জামাল মুন্সি বলেন, ‘বুধবার সকালে আমার ভাই রিকশা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়। ওই দিন গ্যাঞ্জাম চলার সময় (হামলাকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ) সে গুলিবিদ্ধ হয়। ঘটনার পর আমরা তাকে উদ্ধার করে গোপালগঞ্জের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করি। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে আমরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করি। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১টা ৪৫ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়।’

তিনি আরও জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে তাঁর ভাইয়ের লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। এরপর লাশটি তাঁদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। লাশ পেয়ে তাঁরা রওনা দিয়েছেন। রাতেই তাঁর ভাইয়ের লাশ গোপালগঞ্জে পৌঁছানোর কথা। জানাজা শেষে তাঁর ভাইয়ের লাশ গোপালগঞ্জ গেটপাড়া পৌর কবরস্থানে দাফন করা হবে।

এর আগে এ ঘটনায় মারা যাওয়া চারজন হলেন গোপালগঞ্জ শহরের কোটালীপাড়ার হরিণাহাটি গ্রামের রাজমিস্ত্রি রমজান কাজী, শহরের পূর্ব মিয়াপাড়া এলাকার মোবাইল পার্টস ব্যবসায়ী সোহেল রানা, শহরের উদয়ন রোডের পোশাক ব্যবসায়ী দীপ্ত সাহা ও সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার এলাকার দোকান কর্মচারী ইমন তালুকদার। বুধবার গোপালগঞ্জে হামলা-সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনায় এখন পর্যন্ত পরিবার বা পুলিশ কারও পক্ষ থেকেই কোনো মামলা হয়নি। এমনকি ময়নাতদন্ত ছাড়াই নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে চারজনের দাফন ও শেষকৃত্য বুধ ও বৃহস্পতিবার সম্পন্ন হয়েছে। চারজনই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।

নিহত চারজনের ময়নাতদন্ত না হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক বৃহস্পতিবার বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসব।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিহত রমজান কাজীর মামা কলিম মুন্সি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলা নিয়ে আমরা এখন পর্যন্ত কিছু ভাবিনি। কী হবে মামলা করে। আমার ভাগনের লাশ নিয়ে থানায় গেলাম, থানায় ঢুকতে পারলাম না। দ্বিতীয়বার হাসপাতালে গেলে ময়নাতদন্ত করার জন্য সেখানেও দাঁড়াইতেও দিল না। এখন কার কাছে বিচার চাইব। আমাদের বিচার একমাত্র আল্লাহর কাছে।’

তবে ফৌজদারি কার্যবিধি ও পুলিশ প্রবিধান অনুযায়ী, মৃতদেহের ময়নাতদন্তের আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিশেষ করে গুলিতে মৃত্যুর মতো ঘটনায় ময়নাতদন্ত অপরিহার্য। কারণ, এটি আইনি প্রমাণ ও সত্য উদ্‌ঘাটনের অন্যতম প্রধান ভিত্তি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এস এম মাহিদুল ইসলাম সজীব প্রথম আলোকে বলেন, গুলিতে মৃত্যুর ঘটনায় ময়নাতদন্ত না হলে মৃত্যুটি কীভাবে ঘটেছে, সেটি নিশ্চিত হওয়া যায় না। গুলির ধরন, দিক, দূরত্ব, শরীরের কোন অংশে লেগেছে—এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অজানা থেকে যায়। যার প্রভাব বিচারিক প্রক্রিয়াতেও পড়ে। কখনো কখনো প্রকৃত অপরাধ আড়াল হওয়ার সুযোগ থাকে।

এনসিপির ‘পদযাত্রা’ কর্মসূচিকে ঘিরে হামলা–সংঘাতের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে সদর, কাশিয়ানী ও কোটালীপাড়া থানায় তিনটি মামলা করে। এর মধ্যে পুলিশের ওপর হামলা, গাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে সদর থানায় গতকাল মামলাটি করেছেন গোপীনাথপুর পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক আহমদ বিশ্বাস।

সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর মোহাম্মদ সাজেদুর রহমান গতকাল বেলা তিনটার দিকে মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি নিউটন মোল্লা, সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমানসহ ৭৫ জনের নাম উল্লেখ করে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলাটি করা হয়। এই মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার আরেকটি মামলা হয় কাশিয়ানী থানায়। এ বিষয়ে কাশিয়ানী থানার ওসি কামাল হোসেন বলেন, কাশিয়ানী‌ থানার সাম্পান হাইওয়ে রেস্টুরেন্টের সামনের ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে গাছ ফেলে প্রতিবন্ধকতা তৈরির অভিযোগে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ৭০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ৩০০ জনকে আসামি করে একটি মামলা হয়েছে। ওই মামলায় ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

কোটালীপাড়া থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়েছে। ওই থানার উপপরিদর্শক উত্তম কুমার গতকাল ১৫৫ জনের নাম উল্লেখ করে মামলাটি করেন। এ মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও ১ হাজার ৫০০ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ বলেন, এ মামলায় ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এনসিপির সমাবেশ ঘিরে বুধবার হামলা–সংঘাতের ঘটনার পর জারি করা কারফিউর মেয়াদ আবারও বাড়ানো হয়েছে। গতকাল বিকেল সাড়ে চারটার দিকে গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জামান এ তথ্য জানিয়ে বলেন, শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে নতুন করে শুরু হওয়া কারফিউ আগামীকাল শনিবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আলোচনা করে কারফিউর বিষয়ে পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

গোপালগঞ্জ জেলাজুড়ে কারফিউ শুরু হয় বুধবার রাত আটটা থেকে। প্রথম দফায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়। এরপর বৃহস্পতিবার ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ব্রিফিং করে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত জেলাজুড়ে আবার কারফিউ জারি করেন।

কারফিউ চলাকালে সকাল থেকে গোপালগঞ্জ শহর ও আশপাশের এলাকায় যানবাহনের স্বাভাবিক চলাচল দেখা গেছে। সকাল থেকেই আন্তজেলা বাস চলাচল শুরু হয়। গতকালের তুলনায় আজ সড়কে মানুষ বেশি দেখা গেছে।

সকাল সাড়ে আটটার দিকে গোপালগঞ্জের পুলিশ লাইনস ও কুয়াডাঙ্গা মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট ও গোপালগঞ্জ-ব্যাসপুর রুটের বাস ছেড়ে গেছে। দূরপাল্লার বাস চলাচলও গতকালের তুলনায় বেশি ছিল।

গোপালগঞ্জ শহরের কাঁচাবাজার, লঞ্চঘাট, বিসিক এলাকা—এসব জায়গায় মানুষের উপস্থিতি ও ব্যস্ততা বেশি দেখা যায়। বিসিক এলাকায় বাজার করতে আসা কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের একজন সাবিনা বেগম বলেন, ‘গত দুই দিন বাসা থেকে বের হতে পারিনি। তাই আজ সকালে বাজারের উদ্দেশে বের হয়েছি।’

লঞ্চঘাট এলাকায় ইজিবাইক, মাহিন্দ্রা, রিকশা—সব যানবাহন স্বাভাবিকভাবে চলতে দেখা গেছে। চালকেরা নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে যাত্রী নেওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন।

রিকশাচালক উজ্জ্বল হাওলাদার বলেন, ‘পেটের দায়ে রিকশা চালাই। দুই দিন রিকশা চালাতে পারিনি, কোনো যাত্রী ছিল না। ঘরে চাল নেই, পেটের দায়ে বের হয়েছি। ঘরে বসে থাকলে পেটে ভাত যাবে না। আমি জানি কারফিউ চলছে, কিন্তু কী করব? জীবনের তাগিদে বের হয়েছি।’