দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তিন ভাই–বোনের নেই থাকার ঘর, ঠিকমতো জোটে না খাবারও

ফুফুদের পরিত্যক্ত ঘরে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী খাদিজা ও তাঁর দুই ভাই-বোন। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার জিরতলী ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামেছবি: প্রথম আলো।

আট ভাই–বোনের মধ্যে পাঁচজনই ছিলেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। তাঁদের মধ্যে দুজন মারা গেছেন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে। প্রায় এক দশক আগে মারা গেছেন বাবা। স্মৃতিশক্তি হারানো বৃদ্ধা মাকে নিয়ে ফুফুদের পরিত্যক্ত ঘরে কোনোমতে জীবন কাটাচ্ছেন। প্রতিবন্ধী ভাতার দুটি কার্ড ছাড়া সরকারি কোনো সহায়তাই তাঁদের ভাগ্যে জোটেনি আজও। উপজেলা প্রশাসনের কাছে দফায় দফায় ধরনা দিয়েও পাননি প্রধানমন্ত্রীর উপহারের একটি ঘর।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার জিরতলী ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের আনোয়ার উল্যাহ মৌলভীর বাড়ির একটি পরিবারের চিত্র এটি। কিছুদিন আগে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘনবসতিপূর্ণ বাড়ির এক পাশে একটি পরিত্যক্ত ঘরে থাকেন খাদিজা আক্তার (৩০), ছোট বোন শিল্পী আক্তার (২৫) ও তাঁদের মা আনোয়ারা বেগম (৭০)। তাঁদের ভাই আবদুর রহিম (৪১) থাকেন পাশের আরেকটি ঘরে। সেটিও জরাজীর্ণ।

খাদিজা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা চার বোন, চার ভাই। কেউই জন্মগতভাবে প্রতিবন্ধী নন। পাঁচ-ছয় বছর বয়সের পর মণি সাদা হয়ে চোখে ছানি পড়ে। আর্থিক দৈন্যের কারণে বাবা গোলাম মোস্তফা তাঁদের কারও ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারেননি। ২০১৪ সালে তিনি মারা যান। বাবার শোকে মা আনোয়ারা বেগম স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। পরিবারে আরও অন্ধকার নেমে আসে।

২০২২ সালে লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান খাদিজার বড় ভাই জসিম উদ্দিন (৪০)। ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে তাঁর বড় বোন রৌশন আক্তার মারা যান ৮ মার্চ। অর্থের অভাবে তাঁদের কারও যথাযথ চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। মৃত্যুর পর তাঁদের কাফনের কাপড়ও কিনতে হয়েছে প্রতিবেশীদের দানের টাকায়।

খাদিজা আক্ষেপ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গৃহহীনদের ঘর করে দিচ্ছেন শুনে বছরখানেক আগে তাঁরা বেগমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। তখন ইউএনও তাঁদের সামনে রেখেই স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে ফোন করে তাঁদের নাম তালিকাভুক্ত করার নির্দেশ দেন। কিন্তু পরে তাঁদের আর ঘর দেওয়া হয়নি। বাবার রেখে যাওয়া ১৬ শতক জায়গায় ভাঙাচোরা ঘরে তাঁর দুই ভাই পরিবার নিয়ে থাকেন। সেখানে জায়গা না হওয়ায় এখন তাঁরা ফুফুর বাড়িতে পরিত্যক্ত ঘরে থাকেন। প্রতিবন্ধী ভাতার মাসিক ৭৫০ টাকা এবং তাঁদের মায়ের নামে মাসিক ৬০০ টাকার বয়স্ক ভাতাই এখন একমাত্র আয়ের উৎস। প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনদের দয়া ও দানে কোনোমতে জীবন বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁরা।

২০০১ সালে চৌমুহনী সরকারি এস এস কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আবদুর রহিম। তিনি বলেন, ‘চাকরির জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। দুদকে চাকরির মৌখিক পরীক্ষায় আমাকে বাদ দেওয়া হয়। এরপর আর কোথাও চেষ্টা করিনি। অন্ধ হওয়ায় কেউ গুরুত্ব দেয় না। এক বোনের বিয়ে হয়েছে। প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে অন্য দুই বোনকে বিয়ে দিতে পারেননি। টাকাপয়সা থাকলে হয়তো বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা যেত। অসুস্থ ভাই ও বোনকে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা বলেছেন, তাঁদের সব ভাই-বোনেরই ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এ নিয়ে নতুন করে ভয় কাজ করছে।’

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী খাদিজা আক্তার মাধ্যমিক পাস। আরেক বোন শিল্পী আক্তার দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। সরকারিভাবে তাঁদের একটি ঘর ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলে তাঁরা অন্তত একটু শান্তিতে বসবাস করতে পারবেন।

জিরতলী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শামছুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, পরিবারটি একেবারেই নিঃস্ব। তিনি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তিন ভাই-বোনকে সরকারি ভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কিন্তু ভিজিডি ও ভিজিএফ কার্ডের যে বরাদ্দ পাওয়া যায়, তা অপ্রতুল হওয়ায় দিতে পারেননি। তা ছাড়া তাঁর ইউনিয়নে মুজিব বর্ষের ঘর বরাদ্দ পাওয়া গেছে আটটি। কিন্তু চাহিদা আরও বেশি। ভবিষ্যতে ঘর পাওয়া গেলে দেওয়ার চেষ্টা করবেন।

বেগমগঞ্জের ইউএনও মো. আরিফুর রহমান বলেন, পরিবারটির এমন দুরবস্থার কথা তাঁর জানা নেই। তিনি খোঁজ নেবেন এবং প্রয়োজনে নিজেই তাঁদের বাড়িতে যাবেন। মুজিব বর্ষে গৃহহীনদের জন্য ঘর দেওয়ার যে প্রকল্প ছিল, সেটি শেষ। তবু তিনি পরিষদ থেকে কিছু করা যায় কি না ভেবে দেখবেন।