নাসিরনগরের শুঁটকি মেলা: আগে বেচাকেনা ছিল বিনিময় প্রথায়, এখন নগদ টাকায়

নাসিরনগরের এ মেলার ঐহিত্য দীর্ঘদিনের। মেলার প্রধান পণ্য শুঁটকি। বর্তমানে বাংলা সনের দ্বিতীয় দিনে এ মেলা শুরু হয়ছবি: প্রথম আলো

ব্যবসায়ীরা দোকান সাজাতে ব্যস্ত। তাঁদের যেন কথা বলার ফুরসত নেই। তাঁরা বিভিন্ন মাছের তৈরি শুঁটকি পসরা সাজাতে ব্যস্ত। এই চিত্র ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের কুলিকুন্ডা গ্রামের; আজ মঙ্গলবার সকাল সাতটার।

বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে আজ থেকে এখানে দুই দিনব্যাপী শুঁটকি মেলা শুরু হয়েছে। নাসিরনগরের এ মেলার ঐহিত্য দীর্ঘদিনের। মেলার প্রধান পণ্য শুঁটকি। বর্তমানে বাংলা সনের দ্বিতীয় দিনে এ মেলা শুরু হয়। যদিও পুরোনো পঞ্জিকা অনুযায়ী দিনটি পয়লা বৈশাখ। স্থানীয় জেলেরা পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ধরে রাখতে ব্যতিক্রমধর্মী এ মেলা করে থাকেন।

কুলিকুন্ডা গ্রামের কুলিকুন্ডা (উওর) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে মেলা শুরু হয়েছে। গ্রামবাসী ও মেলায় আসা একাধিক ব্যক্তি জানান, কবে মেলা শুরু হয়েছে, তাঁদের জানা নেই। তাঁদের ধারণা, ‘শুঁটকি মেলা’ প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো। যখন কাগজের মুদ্রার প্রচলন হয়নি, তখন স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বী লোকজন নিজেদের উৎপাদিত শুঁটকি বিক্রি করতেন। স্থানীয় কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত চাল, ডাল, ধান, শিমের বিচি, আলু, শর্ষে, পেঁয়াজ, রসুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা পণ্যের বিনিময়ে শুঁটকি কিনতেন। এ মেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল পণ্যের বিনিময়ে শুঁটকি কেনাবেচা। ওই ঐতিহ্য ধরে রাখতে স্বল্প সময়ের জন্য পণ্যের বিনিময়ে শুঁটকির বিনিময় হতো। বর্তমানে ওই ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন নগদ টাকায় বেচাকেনা হয়। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানের ব্যবসায়ীরা এখানে শুঁটকি বেচাকেনা করতে আসেন।

মেলায় বোয়াল, গজার, শোল, বাইম, ছুরি, লইট্টা, পুঁটি, গনা, গুচি, ট্যাংরা আইড়সহ আড়াই শর বেশি ধরনের শুঁটকির পসরা নিয়ে বসেছেন দোকানিরা। এ ছাড়া ইলিশ ও সামুদ্রিক মাছের শুঁটকি রয়েছে। পাশাপাশি ইলিশ ও কার্পজাতীয় বিভিন্ন মাছের ডিমও বিক্রি হচ্ছে। মেলায় স্থানীয় কুমারদের হাতের তৈরি হাঁড়ি, পাতিল, কলসি, ঝাঁজর, থালা, ঘটি, বদনা, বাটি, পুতুলসহ নানা ধরনের সামগ্রী আছে।

আজ সকালে মেলায় এসেছেন উপজেলার গোকুলনীয় ইউনিয়নের জেঠাগ্রামের বাসিন্দা জ্যোৎস্না চৌধুরী। তিনি সঙ্গে করে এসেছেন নিজের উৎপাদিত আম, পেঁয়াজ, চাল, শিমের বিচি ও বেগুন। এসব পণ্যের বিনিময়ে তিনি শুঁটকি নেন।
হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলা থেকে মেলায় এসেছেন মহেশ্বর দাস। তিনি বলেন, এ মেলায় শুঁটকির বেচাকেনা ভালো হয়। ১৫ ধরনের শুঁটকি এনেছেন, যার দাম ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।

আরেক ব্যবসায়ী আবদুর রহমান এসেছেন সরাইল উপজেলা থেকে। তিনি জানান, তিনি ৩০ বছর ধরে মেলায় আসছেন। তাঁর বাবা-দাদাও শুঁটকির ব্যবসা করতেন। ছোটবেলা থেকেই এ মেলায় আসেন।

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, তিনি চুনারুঘাট ও রানীগাও বাজারে শুঁটকি বিক্রি করেন। আট বছর ধরে এ মেলা থেকে শুঁটকি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এখানকার শুঁটকির মান ভালো। এবার তিনি ২০ হাজার টাকার শুঁটকি কিনে নিয়ে যাবেন।

আরও পড়ুন
মেলায় বোয়াল, গজার, শোল, বাইম, ছুরি, লইট্টা, পুঁটি, গনা, গুচি, ট্যাংরা আইড়সহ আড়াই শর বেশি ধরনের শুঁটকির পসরা নিয়ে বসেছেন দোকানিরা
ছবি: প্রথম আলো

উপজেলার হরিণবেড় এলাকার রামেশ্বর দাস বলেন, ‘১০ বছর ধরে মেলায় এসে শুঁটকি বিক্রি করছি। গত বছর দুই দিনে মেলায় দেড় লাখ টাকার শুঁটকি বিক্রি করেছি।’
কলিকুন্ডা গ্রামের বাসিন্দা সাইফুর রহমান মোল্লা বলেন, ‘এই শুঁটকি মেলা উপজেলার ঐতিহ্য। মেলা উপলক্ষে উৎসবের আমেজ উপভোগ করি। ইতিমধ্যে ১ হাজার ৬০০ টাকার শোল, বোয়াল ও বাইম শুঁটকি কিনেছি। বাজারের শুঁটকির চেয়ে এখানকার শুঁটকি অনেক ভালো।’

স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মী শিবলী চৌধুরী বলেন, এ মেলা এখানকার ঐতিহ্য। এখানে বহু মানুষের সমাগম হয়। এলাকার মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে শুঁটকি উপহার হিসেবে পাঠানো হয়।