কর্মীদের কোটি টাকা বেতনই দেন নয়ন

নয়ন হাসান নিজের প্রতিষ্ঠানে যুক্ত করেছেন ২০০ বাংলাদেশি ও ১০০ ফিলিপিনো তরুণ-তরুণীকে।

৩০০ তরুণের কর্মসংস্থান করেছেন নয়ন হাসান
ছবি: প্রথম আলো

নয়নের বয়স এখন ২২ বছর। এ বয়সে প্রায় ৩০০ তরুণের কর্মসংস্থান করেছেন। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, নিজের প্রতিষ্ঠান ইকম সলিউশনসে যুক্ত করেছেন ২০০ বাংলাদেশি ও ১০০ ফিলিপিনো তরুণ-তরুণীকে। ইকম সলিউশনস কর্মীদের মাসিক বেতন দেয় প্রায় এক কোটি টাকা।

ছোট কাঁধে বড় বোঝা

নয়ন হাসানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা শরীয়তপুরের জাজিরায়। বাবা আছমত আকনের পেশা কৃষিকাজ, মা বিলকিস বেগম চাকরি করতেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। ছোট ভাই রবিন ও ছোট বোন আছমাকে নিয়ে টানাটানির সংসার। তাই পরিবারের খরচের চিন্তা কম বয়সেই শুরু করেন নয়ন। স্কুলে পড়ার সময়ই ছাত্র পড়াতে হতো।

এলাকায় নয়নের নামডাক ছিল একটা কারণে—প্রযুক্তির প্রতি তাঁর আগ্রহ থাকায় এলাকায় কারও স্মার্টফোন ও ল্যাপটপ কম্পিউটার বিগড়ে গেলে নয়নের খোঁজ পড়ত। খুশি মনে নয়ন সারিয়ে দিতেন। ২০১২ সালে নয়ন তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। ইচ্ছা হলো কম্পিউটার চালানো শেখার। স্থানীয় প্রশিক্ষণকেন্দ্রে তিন মাসের কম্পিউটার কোর্স করলেন।

প্রশিক্ষণে পথের দিশা

২০১৪ সালে জাজিরা উপজেলায় ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং’ নামের এক কর্মসূচিতে বিনা মূল্যে পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ নিলেন নয়ন। পরের বছর নয়ন জানতে পারেন, আবারও তাঁর জাজিরা উপজেলায় একটি পাঁচ দিনের কম্পিউটার কোর্স করানো হবে। এবারের বিষয় ফ্রিল্যান্সিং। বিষয়টি নয়নের কাছে অপরিচিত। তাঁর আগ্রহ ছিল আবারও কম্পিউটার নিয়ে দিনভর পড়ে থাকতে পারবেন আর তিন বেলা ভালো খাবার খাওয়ার সুযোগ পাবেন। কোর্স করার পর নয়ন ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে আরও জানার চেষ্টা করেন। নিজের কম্পিউটার না থাকা আর গ্রামে ধীরগতির ইন্টারনেট সংযোগের কারণে বেশি দূর এগোতে পারেন না।

উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ২০১৭ সালে ঢাকায় আসেন নয়ন। স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন তিতুমীর কলেজে, ইংরেজি বিভাগে। পরিবারকে সহায়তা দেওয়ার চাপ নয়নের ওপর ছিল। ঢাকায় এসে বিকল্প পথ খুঁজতে থাকেন।

প্রবল ইচ্ছাশক্তি

ইউটিউবে নিয়মিত ফ্রিল্যান্সিং কাজের ভিডিও দেখতেন নয়ন। ইচ্ছা হতো কোনো একটি বিষয়ে দক্ষ হওয়ার। এমন সময় নয়ন যে মেসে থাকতেন, সেখানকার এক বড় ভাই অরবিন্দ কুমার রায় তাঁকে সাহায্য করেন। নয়ন ১২ হাজার টাকা দিয়ে ওয়েব ডেভেলপমেন্টের একটা কোর্স করতে চাচ্ছিলেন। অরবিন্দের আর্থিক সহায়তায় সেটায় ভর্তি হলেন।

প্রতিটি বিষয়ে প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান অর্জন করতেন নয়ন। ধীরে ধীরে শুরু করেন ফ্রিল্যান্সিং। একসময় পেয়ে যান প্রথম গ্রাহক। প্রথম কাজ আসে ২০১৯ সালের শুরুতে। আয় করেন ১০০ ডলার।

নয়ন হাসান

এগিয়ে চলা

প্রথম গ্রাহক নয়নকে অনলাইন দোকান ব্যবস্থাপনার কাজের প্রস্তাব দেন। নয়ন রাজি হয়ে যান। ঢাকায় বসে অনলাইনে একা দোকান সামলাতে সামলাতে আরও একটা দোকানের দায়িত্ব পেয়ে যান। বাড়তে থাকে ‘মার্চেন্ট স্টোর’–এর সংখ্যা। ওয়েব ডেভেলপমেন্টের কোর্স সম্পন্ন না করেই বিশ্বখ্যাত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অ্যামাজন ও ওয়ালমার্টের ‘মার্চেন্ট স্টোর’ ব্যবস্থাপনায় জড়িয়ে যান। রাত জেগে ওই সব দোকানে আসা ভিনদেশি ক্রেতাদের নানা প্রশ্নের জবাব দেওয়া থেকে শুরু করে অর্ডার নেওয়া–দেওয়া, মজুত ব্যবস্থাপনা ও পণ্য গবেষণার কাজ করতেন। কাজ বাড়তে থাকলে আরও দুই তরুণকে ‘মার্চেন্ট স্টোর’ ব্যবস্থাপনার কাজ শেখান। তাঁদের নিয়ে নেন নিজের দলে।

অনলাইনের মার্চেন্ট স্টোর বা মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট হলো, যেখানে কোনো ওয়েবসাইটের পণ্যতালিকার বিস্তারিত তথ্য থাকে। এগুলো কার কাছে বিক্রি হচ্ছে ও কীভাবে সরবরাহ করা হচ্ছে, তার তথ্য থাকে।

নিজের প্রতিষ্ঠান

নয়ন দেশের শতাধিক তরুণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। শুধু দেশেই নয়, নয়নের ইকম সলিউশনসে কাজ করছেন ফিলিপাইনের তরুণেরাও। তাঁরা মূলত ভিনদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও গ্রাহকসেবায় কাজ করেন। নয়নের ভাষায়, ‘যেহেতু আমরা আন্তর্জাতিক ই-কমার্স সাইটগুলোর “মার্চেন্ট স্টোর” ব্যবস্থাপনা করি, তাই যোগাযোগের জন্য ইংরেজি ভাষায় দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন হয়। গ্রাহকসেবার কর্মীদের ইংরেজিতে সাবলীল হওয়া জরুরি।’

নয়নের ইকম সলিউশনসে প্রায় ৩০০ কর্মী ঘরে বসে কাজ করছেন। সবার বয়স ২০ থেকে ২৬ বছরের মধ্যে। এই কর্মীদের প্রতি মাসে এক কোটি টাকার বেশি বেতন দেয় ইকম সলিউশনস। ভবিষ্যতে ইকম সলিউশনসের জন্য একটা অফিস নিতে চান নয়ন। নিজের প্রতিষ্ঠানে এক হাজার তরুণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার ইচ্ছাও আছে তাঁর।