বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছরে ১৫ তদন্ত কমিটি, শাস্তির নজির কেবল একটি

কমিটি না থাকা ছাত্রলীগের উপদলীয় কোন্দলের শিকার হয়েছেন সংগঠনের নেতা-কর্মী, সাধারণ শিক্ষার্থী আবার কখনো ছাত্রদলের কর্মী।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস
ছবি: প্রথম আলো

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের একাধিক পক্ষের মধ্যে একের পর এক হামলা ও সংঘর্ষ লেগেই আছে। গত পাঁচ বছরে এমন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অন্তত ১৫টি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। যার মধ্যে একটি ছাড়া কোনো ঘটনায় কারও শাস্তির নজির নেই। অপকর্মে জড়িত ব্যক্তির শাস্তি না হওয়ায় এসবের পুনরাবৃত্তি ঘটছে।

সর্বশেষ ১২ অক্টোবর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের একটি কক্ষে আটকে ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মুকুল আহমেদকে রাতভর নির্যাতন এবং পিটিয়ে হাত ভেঙে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির মুখোমুখি করা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয় ২০১২ সালে। শুরু থেকে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি না থাকলেও ২০১৮ সালের পর কিছু শিক্ষার্থী সংগঠনটির পরিচয়ে ক্যাম্পাসে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হন। যাঁরা আবার প্রভাববলয় সৃষ্টিকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে উপদলীয় কোন্দলে জড়ান। গত প্রায় পাঁচ বছরে ছাত্রলীগের এই কোন্দলের শিকার হয়েছেন কখনো দলের কর্মী, সাধারণ শিক্ষার্থী আবার কখনো ছাত্রদলের কর্মী।

সাবেক মেয়র-সংসদ সদস্যের পরিচয়ে ছাত্ররাজনীতি

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুরুতে বরিশাল সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারী পরিচয়ে ছাত্রলীগের কর্মীরা ক্যাম্পাসে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। ২০২১ সালের মাঝামাঝি সদর আসনের সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের অনুসারী হিসেবে আরেকটি পক্ষ ক্যাম্পাসে সক্রিয় হয়। যার নেতৃত্বে আছেন রক্তিম হাসান ও ময়ীদুর রহমান ওরফে বাকি।

অন্যদিকে মেয়রের অনুসারী পক্ষটির নেতৃত্বে ছিলেন মহিউদ্দীন আহমেদ ওরফে সিফাত, আলীম সালেহীসহ কয়েকজন। গত বছরের ৫ জুলাই রাতে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর গত মে মাস পর্যন্ত প্রতিমন্ত্রীর পক্ষটিকে আর ক্যাম্পাসে দেখা যায়নি।

এরপর মহিউদ্দীন আহমেদ ক্যাম্পাসে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। গত ২৫ জানুয়ারি শেরেবাংলা হলের একটি কক্ষে ঢুকে মহিউদ্দীনকে কুপিয়ে জখম করে প্রতিপক্ষ। এ ঘটনায় মহিউদ্দীন আহমেদ বাদী হয়ে সাতজনকে আসামি করে বন্দর থানায় মামলা করেন। মামলায় আলীম সালেহী, রিয়াজ মোল্লা ও তাঁদের সহযোগী চারজনকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। বর্তমানে তাঁরা জামিনে আছেন। এ হামলার পর মহিউদ্দীনেরই অনুসারী তাহমিদ জামান ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ নেন।

ছাত্রলীগের কর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, এবার সিটি নির্বাচনে সাদিক আবদুল্লাহ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পাওয়ায় জাহিদ ফারুকের সমর্থক পক্ষটি ক্যাম্পাসে সক্রিয় হয়। অন্যদিকে সাদিক আবদুল্লাহর পরিচয়ে আধিপত্য বিস্তারকারী পক্ষটি নবনির্বাচিত মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে।

শিক্ষার্থীরা জানান, গত ৫ আগস্ট সংঘাতের পর বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় ছাত্রলীগের দুটি পক্ষ শিক্ষকদের মধ্যস্থতায় সমঝোতা করে। সে অনুযায়ী একটি পক্ষ শেরেবাংলা এবং অপর একটি পক্ষ বঙ্গবন্ধু হল নিয়ন্ত্রণ করছে।

আবুল খায়ের আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত নগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আফজালুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। তাই একেক সময় একেকটি পক্ষ নেতাদের নাম ভাঙিয়ে এসব অপকর্ম করে।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এক পক্ষে নেতৃত্ব দেওয়া অমিত হাসান প্রথম আলোকে বলেন, কমিটি না থাকলেও কেন্দ্রীয় নির্দেশনা মেনে তাঁরা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। তাঁরা সবাই প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক ও নবনির্বাচিত মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহর নির্দেশনা মেনে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন।

একের পর এক হামলা–পাল্টাহামলা

গত ২৪ জানুয়ারি ভোরে ছাত্রলীগের একটি পক্ষ হেলমেট ও মুখোশ পরে শেরেবাংলা হলে হামলা চালায়। হামলাকারীরা ওই হলের নিয়ন্ত্রণে থাকা মহিউদ্দীন আহমেদ ও তাঁর এক সহযোগীকে গুরুতর আহত করে। এ ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এরপর ৫ আগস্ট পুনরায় আরেকটি পক্ষ হেলমেট ও মুখোশ পরে বঙ্গবন্ধু হলে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালায়। এ সময় আয়াত উল্লাহ নামের এক কর্মীকে বেদম পিটিয়ে পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়। এ ঘটনায়ও তদন্ত কমিটি হয়েছিল।

এর আগে গত ৩ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরেবাংলা হলের তিনটি কক্ষ থেকে দেশি অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য উদ্ধার করে হল প্রশাসন। কক্ষগুলোয় ছাত্রলীগ ‘নেতা’ তাহমিদ জামান ওরফে নাভিদ এবং তানজীদ মঞ্জু অনুসারীদের নিয়ে থাকতেন। হল কর্তৃপক্ষ কক্ষগুলো সিলগালা করে দিলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

২০২০ সালের ১ মার্চ পরীক্ষা দিয়ে হল থেকে বের হয়ে হামলার শিকার হন গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল নওরীণ। তাঁকে পিটিয়ে ও কম্পাসের কাঁটা দিয়ে খুঁচিয়ে গুরুতর জখম করা হয়েছিল। নওরীণ ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী। তাঁর অভিযোগ, ছাত্রলীগ এ হামলা চালায়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছিল। কিন্তু ওই প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। পরে নওরীণ বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন।

২০২১ সালের ৫ জুলাই রাতে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে ক্যাম্পাসে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনায় সাতজন আহত হন। এ ঘটনায়ও তদন্ত কমিটি হয়েছিল। কিন্তু কারও শাস্তি হয়নি।

২০১৯ সালের শেষ দিকে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের দুই দফায় সংঘর্ষে দুজনকে কুপিয়ে জখম করা হয়। ওই ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আল সামাদ ও তাহমিদ জামানকে সাময়িক বহিষ্কার করে প্রশাসন। কয়েক দিন পর তাহমিদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। আল সামাদকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছিল। এটাই ছিল এখন পর্যন্ত একমাত্র শাস্তির নজির।

ছাত্রলীগের একাধিক ‘নেতা’ বলেন, পাঁচ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সংঘাতের ঘটনায় বন্দর থানা ও কোতোয়ালি থানায় অন্তত ১৫টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। এ ছাড়া দুটি মামলা মীমাংসা হয়ে গেছে। অন্য মামলাগুলোর এখনো কোনো অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মো. খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, শুরুতে তাঁরা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে লঘু শাস্তির দিকটা বিবেচনা করতেন। কিন্তু গত কয়েক বছরে এসব ঘটনায় ঘুরেফিরে ১০ থেকে ১২ জনের নাম আসছে। এসব হানাহানি বন্ধে এখন তাঁরা সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থানে রয়েছেন।