বন্যার পানিতে তলিয়েছিল মানুষের ঘরবাড়ি, জমি–জিরাত। প্রাণে বাঁচতে মানুষজন আশ্রয় নিয়েছিল স্কুলঘরে। কিন্তু এবার বুঝি কৃষকের বাঁচার উপায় নেই। কারণ, বন্যায় আমনের বীজতলা তলিয়েছিল। মাঠে আমন ধান বুনবেন কী করে! হাকালুকি হাওরপারের কৃষকের তাই মাথায় হাত। কৃষকের এমন দুর্দিনে এগিয়ে এল কৃষি বিভাগ, উপজেলা প্রশাসন ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে উঁচু মাঠগুলো বীজতলা তৈরির জন্য দেওয়া হলো।
মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার ১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও একটি সরকারি সংস্থা তাদের নিজস্ব খালি মাঠ ছেড়ে দিল কৃষকদের জন্য। সেখানে বীজতলা হলো। এবার সেই হালিচারা কৃষকেরা নিজেদের জমিতে বুনবেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বিনা মূল্যে দেওয়া হবে এই হালিচারা।
কথা হয় বড়লেখার দাসেরবাজার উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীপক রঞ্জন দাসের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, স্কুলের মাঠ এখন খালিই পড়ে আছে। বন্যাদুর্গত মানুষকে সহযোগিতার কথা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েই মাঠে বীজতলা তৈরি করা হয়েছে। চারা উত্তোলনের পর প্রশাসনের সহযোগিতায় মাঠ ঠিক করে নেওয়া হবে।
‘আমি মনে করি এটি একটি শুভ উদ্যোগ। এ রকম একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার অংশ হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে, এটিকে অভিনন্দন জানাই। তবে খেয়াল রাখতে হবে, চারা তুলে নেওয়ার পর মাঠের যে জায়গায় বীজতলা তৈরি করা হয়েছে সেটি যেন দ্রুত ঠিকঠাক করে দেওয়া হয়।’অধ্যাপক এম এ সাত্তার মণ্ডল, কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য
কৃষি বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বড়লেখার হাকালুকি হাওরাঞ্চল দীর্ঘমেয়াদি বন্যার কবলে পড়ে। ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে হাকালুকি হাওরপারের সুজানগর, তালিমপুর, বর্নি ও দাসেরবাজার ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকা বন্যাকবলিত হয়।
বন্যার পানিতে শুধু খেতের জমিই ডোবেনি, রাস্তাঘাট বাড়িঘর তলিয়ে যায়। এসব এলাকার অনেক স্থানে জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত পানি আটকে ছিল। এত দিন আমনের বীজতলার জমি পানিতে তলিয়ে থাকায় আমন চাষিরা চারা তৈরি নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন। চারা তৈরির সময়ও পেরিয়ে যেতে থাকে। চাষিদের পক্ষে হালিচারা তৈরি কিংবা কিনে রোপা আমনের চাষ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
বন্যার পানি অনেক দিন আটকে ছিল। কৃষকেরা আমনের হালিচারা করতে পারছিলেন না। হাওরবেষ্টিত এলাকায় হালিচারার চাহিদা আছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় চাষিদের মধ্যে বিনা মূল্যে এই হালিচারা বিতরণ করা হবে।দেবল সরকার, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা
জমি ও বীজতলার হিসাব
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত ২৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে বীজতলাগুলো তৈরি করা হয়েছে। চারার বয়স ২৫ থেকে ৩০ দিন হলেই জমিতে রোপণ করা যাবে। সে হিসাবে আগামী ২৫ আগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বীজতলার চারা আমন ধানের জমিতে বপন করার কথা।
১২টি প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণে প্রায় ১৮ বিঘা জমিতে বীজতলা করা হয়েছে। বিআর-২২ জাতের ১ হাজার ২০০ কেজি বীজ বপন করা হয়েছে। এক বিঘা বীজতলার হালিচারায় কম করেও ২০ বিঘা জমিতে ধান রোপণ করা যায়। আর এক বিঘা জমি থেকে ১৫ মণ ধান পাওয়া যায়। বিআর-২২ নাবি জাতের আলোক সংবেদনশীল ধান। এটি রোপণের সময় ২৫ আগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বর। এরপরও অনেকে রোপণ করেন অবশ্য। এই ধান দেরিতে রোপণ করা হলেও অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিকে ধান পেকে যায়।
উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় বড়লেখায় ৩২৫ হেক্টর বোনা আমন ধান নষ্ট হয়েছে। বন্যার ক্ষতি পোষাতে কৃষকদের জন্য বিকল্প এই উদ্যোগ। উপজেলায় এবার আমনের লক্ষ্যমাত্রা ৮ হাজার ৭৬০ হেক্টর। আমন চাষি হচ্ছেন ১৩ হাজার ১৪০ জন। এই কার্যক্রমে উপজেলার মোট আমন চাষির ৭ শতাংশ এবং বন্যাকবলিত এলাকার ১২ শতাংশ উপকৃত হবেন। ৯১০ জন কৃষক ৩৪টি বীজতলার হালিচারা রোপণ করতে পারবেন।
বন্যার পর দেখা গেল পানি ধীরে নামছে। হালিচারা করার জন্য জায়গা নেই। তাই উপজেলা কৃষি পুনর্বাসন কমিটি থেকে খালি জায়গা, স্কুলমাঠ ও উঁচু স্থানের পতিত জমিতে হালিচারা করা হয়েছে।খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)
যেসব স্থানে বীজতলা
বীজতলা তৈরিতে চাষ, মজুরি, বেড়াসহ প্রয়োজনীয় আর্থিক সহযোগিতা করেছে উপজেলা পরিষদ। প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণে রোপা আমনের বিকল্প বীজতলার স্থানগুলো হচ্ছে বড়লেখা পৌর এলাকার রেলওয়ের যুবসংঘের মাঠ, নারীশিক্ষা একাডেমির স্কুল ও কলেজ অংশের দুটি প্রাঙ্গণ, ইটাউরি হাজী ইউনুছ মিয়া মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয়, দাসেরবাজার উচ্চবিদ্যালয়, ইউনাইটেড উচ্চবিদ্যালয়, শাহবাজপুর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, পশ্চিম বর্নি আয়মনা বেগম উচ্চবিদ্যালয়, কটালপুর হাফিজিয়া মাদ্রাসা, চানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গুলুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং রংপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
বড়লেখা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দেবল সরকার প্রথম আলোকে বলেন, বন্যার পানি অনেক দিন আটকে ছিল। কৃষকেরা আমনের হালিচারা করতে পারছিলেন না। হাওরবেষ্টিত এলাকায় হালিচারার চাহিদা আছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় চাষিদের মধ্যে বিনা মূল্যে এই হালিচারা বিতরণ করা হবে।
আরও ২২ স্থানে বীজতলা
বিকল্প ব্যবস্থায় এই বীজতলা তৈরি করা হয়েছে বন্যাকবলিত হাওরপারের বর্নি ইউনিয়নের কাজিরবন্দ, ছালিয়া, নয়াগ্রাম, সৎপুর, পাকসাইল; তালিমপুর ইউনিয়নের পশ্চিম গগড়া, দ্বিতীয়ারদেহী, মুর্শিবাদকুরা, কুটাউড়া, হাল্লা; সুজানগরের জগড়ি, তেরাকুড়ি, দশগড়ি, উত্তর শাহবাজপুরের অর্জুনপুর, আতোয়া, ভট্টশ্রী এবং দাসেরবাজারের সোনাপুর, চানপুর, ধর্মদেহী, মাইজমজুরি এলাকার চাষিদের কথা চিন্তা করে।
কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় সরকারিভাবে বিনা মূল্যে বীজ ও সার প্রণোদনা দিয়ে আরও ২২টি উঁচু ও পতিত স্থানে ৩০ বিঘা জমিতে বীজতলা তৈরি করা হয়েছে। এগুলো করেছেন স্থানীয় কৃষকেরা।
শাহবাজপুর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কয়ছর আহমদ বলেন, চারা তৈরি করায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না। অনেক খালি জায়গা আছে। আর গরম এখন। বাচ্চারা খুব একটা খেলাধুলাও করে না।
বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী প্রথম আলোকে বলেন, বন্যার পর দেখা গেল পানি ধীরে নামছে। হালিচারা করার জন্য জায়গা নেই। তাই উপজেলা কৃষি পুনর্বাসন কমিটি থেকে খালি জায়গা, স্কুলমাঠ ও উঁচু স্থানের পতিত জমিতে হালিচারা করা হয়েছে। যাদের হালিচারা করার সুযোগ ছিল না, এখন তাঁদের সহযোগিতা করা যাবে।
জানতে চাইলে কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এম এ সাত্তার মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মনে করি এটি একটি শুভ উদ্যোগ। এ রকম একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার অংশ হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে, এটিকে অভিনন্দন জানাই। তবে খেয়াল রাখতে হবে, চারা তুলে নেওয়ার পর মাঠের যে জায়গায় বীজতলা তৈরি করা হয়েছে সেটি যেন দ্রুত ঠিকঠাক করে দেওয়া হয়।’