‘এক বেলার চাল-ডাল কিনলেই তো টাকা শেষ, মালিকেরা কি এইটা বুঝেন না’

মৌলভীবাজার-বড়লেখা আঞ্চলিক মহাসড়কে চা-শ্রমিকদের মানববন্ধন। আজ শনিবার জুড়ী উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ মুমিত চত্বরে
ছবি: প্রথম আলো

প্রখর রোদে কয়েক হাজার চা-শ্রমিক সড়কের দুই পাশে দাঁড়িয়েছেন। মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছেন। সেখানে হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন কাজলি রাজবংশী (৪০)। শরীর বেয়ে ঝরছিল ঘাম। মজুরি বৃদ্ধির দাবির বিষয়ে প্রশ্ন করতেই শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে কাজলি বলেন, ‘বাজারে কোনো জিনিসের দাম তো কম নেই। এক বেলার চাল-ডাল কিনলেই সব টাকা শেষ। আর কিছু লাগে না? ১২০ টাকা মজুরিতে এই সময়ে একটা সংসার চলে? বাগানমালিকেরা কি এইটা বুঝেন না?’

তাঁর কথায় ‘ঠিক, ঠিক’ বলে সায় দেন পাশে দাঁড়ানো আরও ১০ থেকে ১২ জন নারী শ্রমিক। এরপর সমস্বরে স্লোগান ধরেন, ‘রুটি-রুজির সংগ্রাম—চলছে, চলবে’, ‘মজুরি নিয়ে টালবাহানা—চলবে না, চলবে না’।

১২০ টাকার মজুরি ৩০০ টাকা করার দাবিতে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের প্রথম দিনে আজ শনিবার মৌলভীবাজারের জুড়ীতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন চা-শ্রমিকেরা। চা-শ্রমিক ইউনিয়নের জুড়ী ভ্যালি কমিটির ব্যানারে মৌলভীবাজার-বড়লেখা আঞ্চলিক মহাসড়কের জুড়ী উপজেলা সদরের জাঙ্গিরাই এলাকায় এই কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।

সরেজমিন দেখা গেছে, জুড়ী ভ্যালির আওতাধীন জুড়ীসহ আশপাশের বড়লেখা ও কুলাউড়া উপজেলার বিভিন্ন বাগানের শ্রমিকেরা মিছিল নিয়ে জাঙ্গিরাই এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ মুমিত চত্বরে জড়ো হন। সেখানে অন্তত পাঁচ হাজার শ্রমিক সড়কের দুই পাশে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন শুরু করেন। পরে প্রায় আধা ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখেন। এতে সড়কের দুই পাশে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে।

বিভিন্ন বাগানের শ্রমিকেরা মিছিল নিয়ে জাঙ্গিরাই এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ মুমিত চত্বরে জড়ো হন
ছবি: প্রথম আলো

জুড়ী ভ্যালি চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি কমল চন্দ্র বুনার্জির সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক রতন কুমার পালের সঞ্চালনায় বিভিন্ন বাগানের শ্রমিক পঞ্চায়েত কমিটির নেতারা সেখানে বক্তব্য দেন। এ ছাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ মোঈদ, ভাইস চেয়ারম্যান রিংকু রঞ্জন দাসসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা সংহতি জানিয়ে বক্তৃতা রাখেন।

আরও পড়ুন

চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে চা-বাগানের মালিকপক্ষের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা-সংসদের করা চুক্তি অনুযায়ী, চা-শ্রমিকদের মজুরিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করা হয়। প্রতি দুই বছর পরপর এ চুক্তি সম্পাদনের কথা। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদন হয়। ওই চুক্তিতে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরে আর নতুন করে চুক্তি হয়নি। সম্প্রতি চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশীয় চা-সংসদ মজুরি ১৪ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়। কিন্তু নেতারা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, ‘দাবি পূরণের ব্যাপারে আগেই আমরা মালিকপক্ষকে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলাম। কিন্তু মালিকপক্ষ সাড়া দেয়নি। এরপর লাগাতার চার দিন দুই ঘণ্টা করে প্রত্যেক বাগানে কর্মবিরতি পালিত হয়েছে। তাতেও মালিকপক্ষ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তাই, বাধ্য হয়ে ধর্মঘট ডাকা হয়েছে।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশীয় চা-সংসদের চেয়ারম্যান মো. শাহ আলম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্দোলনে যাওয়ার কিছু প্রক্রিয়া রয়েছে। কিন্তু, শ্রমিকেরা যা করছেন, তা শ্রম আইনবিরোধী। এভাবে তাঁরা আন্দোলনে যেতে পারেন না। এতে চা–শিল্পের পাশাপাশি তাঁদেরও ক্ষতি হচ্ছে। শ্রমিক সংগঠন চিঠি দেওয়ার পর আমরা সেটার জবাব দিয়েছি। চিঠিতে আমাদের অবস্থান তুলে ধরেছি। আলোচনার জন্য আমাদের দরজা সব সময়ই খোলা। তবে একদিকে আন্দোলন, অন্যদিকে আলোচনা—দুটো তো একসঙ্গে চলে না। তাঁরা যেকোনো সময় আমাদের সঙ্গে এসে আলোচনায় বসতে পারেন।’

আরও পড়ুন