৫০ বছর ধরে এক পায়ে লাফিয়ে পথ চলছেন ইয়াসিন আলী

শারীরিক প্রতিবন্ধী ইয়াছিন আলী এক পায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে চলেন। সম্প্রতি রাজশাহীর বাগমারার হামিরকুৎসার আলোকনগর বাজারে
ছবি: প্রথম আলো

এক পায়ের ওপর ভর করে লাফিয়ে লাফিয়ে চলছেন মাঝবয়সী এক ব্যক্তি। কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর একটু থেমে বিশ্রাম নিয়ে আবার লাফানো শুরু করছেন তিনি। এভাবে প্রায় ৫০ বছর ধরে লাফিয়ে পথ চলছেন তিনি।

ইয়াছিন আলী শাহ (৫৬) নামের এই ব্যক্তির বাড়ি রাজশাহীর বাগমারার গোয়ালকান্দি ইউনিয়নের পলাশী গ্রামে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও জীবনসংগ্রামে কখনো পিছিয়ে পড়েননি তিনি। হার না মানা একজন মানুষ হিসেবেই ইয়াছিন আলীকে চেনেন এলাকার মানুষ।

লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে যান। অনেক সময় গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেয়েও পড়তে হয়। এরপরও নিজেকে সামলে নিয়ে চলেন।

পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছয় বছর বয়সে ইয়াছিনের বাঁ পায়ের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। তবে আরেকটি পায়ের বৃদ্ধি স্বাভাবিক থাকে। বিষয়টি টের পাওয়ার পর বিলম্ব করেননি মা–বাবা। সেই সময়ের চিকিৎসক–কবিরাজের কাছে ছুটে কিছু চিকিৎসা করিয়েছেন। একসময় হতাশ হয়ে পড়েন মা–বাবা। ছেলে প্রতিবন্ধী হবে, এটা মেনে নিয়ে বড় করতে থাকেন শিশু ইয়াছিন আলী শাহকে। সেই ছয় বছরের শিশুর বয়স এখন ৫৬ বছর। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি তিনি।

চলাফেরায় খুব কষ্ট হয় ইয়াছিন আলীর। এ অবস্থায় তিনি সংসারের হাল ধরেছেন। সংসারের কাজও করেন তিনি। তিন ছেলে-মেয়েকে বড় করেছেন। বড় দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট এক ছেলে রয়েছে।

ইয়াছিন আলী জানান, অন্যের সহযোগিতা নিয়ে চলাফেরার পাশাপাশি সংসারও চালান। বেশিক্ষণ তিনি হাঁটতে পারেন না। সর্বোচ্চ ১০ মিনিট তিনি এক পায়ের ওপর ভর করে লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে পারেন। এরপর থেমে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর পথ চলেন। এভাবে চলতেও বেশ সমস্যা হয় বলে জানিয়েছেন। পায়ে কোনো জুতা–স্যান্ডেল দেওয়া যায় না। এ জন্য সমস্যা বেশি হয় তাঁর। এরপরও জীবনের তাগিদে তাঁকে চলতে হয়।

কষ্টের বিবরণ দিতে গিয়ে একসময় কেঁদে ফেলেন তিনি। জানান, লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে যান। অনেক সময় গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেয়েও পড়তে হয়। এরপরও নিজেকে সামলে নিয়ে চলেন।

তাঁর ভাষ্যমতে, সাত বছর ধরে প্রতিবন্ধী ভাতা পেয়ে আসছেন। সামান্য জমিজমা রয়েছে, এসব চাষাবাদ করে ও অন্যের পানবরজে কাজ করে কোনোরকম সংসার চালানো যায়। তবে একটি অটো হুইলচেয়ার (চার্জারসহ) পেলে হয়তো আর লাফিয়ে চলতে হবে না। সেখানে বসে চলতে পারতেন বলে মন্তব্য করেন। তবে এ জন্য যে টাকা লাগবে, তা কেনার সামর্থ্য নেই বলে জানান।

স্ত্রী রাশেদা বেগম বলেন, তাঁর স্বামীর চলাফেরা করতে সমস্যা হয়। লাফিয়ে ছাড়া চলতে পারেন না। সংসারের জমিজমা চাষাবাদ ছাড়াও অন্যের খেতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এসব কাজে তিনি সহযোগিতা করে থাকেন। তবে হাটবাজার বা বাইরে গেলে সহযোগিতা করা যায় না। স্বামীকে লাফিয়েই চলতে হয়।

ইয়াছিনের প্রতিবেশী ভ্যানচালক হাবিবুর রহমান (৩০) বলেন, ইয়াছিন আলীর লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে দেখে কষ্ট লাগে। তাই সুযোগ পেলে মাঝেমধ্যে বিনা ভাড়ায় বাড়িসহ নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেন।

ওই গ্রামের বাসিন্দা স্কুলশিক্ষক আনোয়ার হোসেন জানান, প্রতিবন্ধী ইয়াছিন আলী শাহ খুব পরিশ্রমী। হার না মানা একজন মানুষ। তিনি অন্যের কাছে হাত না পেতে কষ্ট করে কাজ করে সংসার চালান। তবে তাঁর লাফিয়ে লাফিয়ে চলা দেখে কষ্ট হয়।

স্থানীয় গোয়ালকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আলমগীর সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ইয়াছিন আলী শাহর লাফিয়ে চলতে দেখে কষ্ট হয়। তাঁকে প্রতিবন্ধী ভাতাভুক্ত করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদে কোনো হুইলচেয়ারের বরাদ্দ পাওয়া যায় না। এটা উপজেলা থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়।