‘মাস শেষে সঞ্চয় করার কথা চিন্তাও করতে পারি না’

নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন পোশাকশ্রমিকেরা। গতকাল রোববার গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কোনাবাড়ি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

পোশাক কারখানার শ্রমিক আসাদুল ইসলামের বাড়ি রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ইটাকুমারী গ্রামে। এক দশক আগে আসাদুল পরিবার নিয়ে কাজের খোঁজে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নলজানি এলাকায় আসেন। এখন তিনি নিজে পোশাক কারখানায় কাজ করেন। আসাদুলের স্ত্রী পারভীন আক্তার আরেকটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে এক কক্ষের একটি বাসায় ভাড়া থাকেন আসাদুল।

আসাদুল আর পারভীন খাটে ঘুমান। আর সন্তানেরা ঘুমায় মেঝেতে। ছোট্ট ওই বাসার ভাড়া গুনতে হয় সাড়ে তিন হাজার টাকা। ছোট্ট এক কক্ষে কীভাবে থাকেন, জানতে চাইলে আসাদুল বলেন, ‘দুই রুমের বাসা ভাড়া নেওয়ার মতো আর্থিক অবস্থা নেই। বাড়িতে মা-বাবা দুজনই অসুস্থ। তাঁদের চিকিৎসার জন্য মাসে পাঁচ হাজার টাকা পাঠাতে হয়। টানাটানির সংসার। স্বামী-স্ত্রী মিলে যা আয় করি, তা দিয়ে বাসাভাড়া, বাজার খরচ ও মা–বাবার চিকিৎসার পেছনে খরচ হয়ে যায়। মাস শেষে সঞ্চয় করার কথা চিন্তাও করতে পারি না।’

আগে ২৫ কেজি চালের বস্তা কিনতাম। এখন একসঙ্গে ২৫ কেজি কেনার সাধ্য নেই। চার থেকে পাঁচ কেজি করে কিনি কয়েকবার। তেল আগে আড়াই লিটার কিনতাম। এখন দেড় লিটার কিনি।
হাফিজা খাতুন, পোশাকশ্রমিক

আসাদুলের মতো দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকেই ভাগ্য বদলের আশায় ছুটে আসেন গাজীপুরে। শিল্প এলাকা হওয়ায় এখানে কাজের সুযোগ বেশি। তবে যে আশা নিয়ে মানুষ গাজীপুরে ছুটে এসেছেন, তা পূরণ হচ্ছে না। কোনোমতে খেয়েপরে দিন কাটছে তাঁদের। আবারও এক দফা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ায় নিম্নআয়ের এসব মানুষ বিপাকে পড়েছেন। প্রতিদিনের সংসার খরচ আর মাস শেষে বাড়িভাড়া দিতে তাঁদের হাত খালি হয়ে যাচ্ছে। দুই দিন ধরে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকার কয়েকজন কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।

প্রায় ১৩ বছর আগে হাফিজা খাতুন কাজের সন্ধানে এসেছিলেন গাজীপুরে। তাঁর বাড়ি খুলনার কয়রা উপজেলার বালাডাঙায়। বর্তমানে তিনি গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কোনাবাড়ি তমিজউদ্দিন নামের একটি টেক্সটাইল কারখানায় কাজ করেন।

হাফিজা খাতুন বলেন, ‘প্রথম যখন এই শহরে আসি বেতন ছিল ১ হাজার ৮০০ টাকা। এখন বেতন ৯ হাজার টাকা। ১৩ বছরেও ভাগ্য পরিবর্তিত হয়নি, তবে খেয়েপরে বেঁচে আছি। এখন আবার নতুন করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। আগে ২৫ কেজি চালের বস্তা কিনতাম। এখন একসঙ্গে ২৫ কেজি কেনার সাধ্য নেই। চার থেকে পাঁচ কেজি করে কিনি কয়েকবার। তেল আগে আড়াই লিটার কিনতাম। এখন দেড় লিটার কিনি। সবকিছুর দাম বেশি। বড় মাছ, মাংস খাইতে মন চায়, কিন্তু পারি না।’

এদিকে কুড়িগ্রাম রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানগর এলকার মরিয়ম খাতুন বর্তমানে গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকার একটি কারখানায় কাজ করেন। সারা মাস কাজ করে তিনি বেতন পান আট হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘দেড় মাস ধরে কোনো ওভারটাইম হয় না। মাত্র আট হাজার টাকা বেতন পাই। এই বেতন থেকে তিন হাজার টাকা যায় ঘর ভাড়ায়। বাকি পাঁচ হাজার টাকায় সংসারের খরচ চালাতে হয়। দুই মাস আগেও কষ্ট করে চলতে পারতাম। কিন্তু এখন আর সেটা পারছি না।’

গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় রিকশা চালান মো. তফিজ উদ্দিন। স্ত্রী রোজিনা খাতুনকে নিয়ে পাঁচ বছর আগে জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থেকে গাজীপুরে আসেন তিনি। প্রথমে পোশাক কারখানায় কাজ করলেও করোনার পর থেকে তিনি রিকশা চালানো শুরু করেন।

তফিজ উদ্দিন বলেন, রিকশা চালিয়ে তিনি মাসে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা রোজগার করেন। এই টাকায় দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচ আর সংসারের খরচ চলে না। তাই তাঁর স্ত্রী একটি পোশাক কারখানায় কাজ নিয়েছেন। এখন স্বামী-স্ত্রী মিলে ১৮ হাজার টাকার মতো আয় করেন। দুজনের আয়ে কোনোরকমে সংসার চলছে। সংসারের সব খরচের পর মাস শেষে কখনো এক হাজার টাকা অতিরিক্ত থাকে। কখনো সেটাও থাকে না।

জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক জোটের কোনাবাড়ি শাখার সভাপতি মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, সংসারে একজনের আয় দিয়ে এখন আর টিকে থাকা যাচ্ছে না। অনেক সংসারে স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরি করছেন। নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি শ্রমিকদের জীবনসংগ্রাম আরও কঠিন করে দিয়েছে। গাজীপুরে কাজের সুযোগ বেশি থাকলেও জীবনমানের উন্নতি হচ্ছে না। এখানকার শ্রমিকেরা শুধু খেয়েপরে বেঁচে আছেন।