কাউয়াদীঘি হাওর
নিষিদ্ধ জালে মাছ শিকার
বেড় জাল ও কারেন্ট জালে বেশি মাছ ধরা পড়ে। এ কারণে নিষিদ্ধ জেনেও জেলেরা এই জাল ব্যবহার করেন।
মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরে নিষিদ্ধ বেড় জাল ও কারেন্ট জালে মাছ ধরা চলছে। বেড় জালে মাছের ডিমসহ দেশি জাতের বিলুপ্তপ্রায় ছোট–বড় মাছ, বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ উঠে আসে। এতে মাছের উৎপাদন ব্যাহত হওয়াসহ হাওরের প্রাণ-প্রতিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে।
মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলায় বিস্তৃত কাউয়াদীঘি হাওর। তবে এর বেশির ভাগ অংশই পড়েছে রাজনগরে। বর্ষায় প্রায় ১২ হাজার হেক্টরজুড়ে থাকে ভাসান পানি। পানি কমে গেলে ছোট–বড় ১০২টি বিল ভেসে ওঠে।
মৎস্য বিভাগ, জেলে এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বর্ষায় হাওর পানিতে ভরে উঠলেই হাওরপাড়ের গ্রামগুলোর জেলেরা মাছ ধরতে তৎপর হয়ে ওঠেন। এ সময় তাঁরা নিষিদ্ধ বেড় জালই বেশি ব্যবহার করেন। এই জালে মাছের ডিমসহ মাছের ক্ষুদ্র পোনা, শামুক-ঝিনুক, জলজ পোকামাকড়, শ্যাওলা-শালুক, সিংড়াসহ বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ উঠে আসে। জালে উঠে আসা অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদ মারা যায়। এগুলো পানিতে ছুড়ে ফেলা হয়। আষাঢ় থেকে ভাদ্র এই সময়টিতেই বেশি বেড় জালে মাছ ধরা হয়ে থাকে।
মুশকিল হলো তাঁরা রাতের বেলা এই জাল দিয়ে মাছ ধরে। দিনে হাওর খালিই থাকে। রাতে হওয়ায় তাদের হাতেনাতে ধরা যায় না। এই জাল মাছের বংশ ও হাওরের পরিবেশ ধ্বংস করছে।আলতাফ হোসেন রাজনগর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব)
হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটি মৌলভীবাজার সদর উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাজন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারেন্ট ও বেড় জাল বিক্রি, ব্যবহার দুটিই নিষিদ্ধ। কিন্তু তা বন্ধ হচ্ছে না। এতে অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্তসহ উৎপাদন কমে যাচ্ছে। অনেক জলজ উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।’
মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মৎস্য আইনে বেড় জাল ব্যবহারে সর্বনিম্ন এক বছর ও সর্বোচ্চ তিন বছরের জেল এবং সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান আছে।
সম্প্রতি ১৩-১৪টি বড় আকারের বেড় জাল নিয়ে হাওরটিতে জেলেরা মাছ ধরছেন। একটি জালের দৈর্ঘ্য ২ হাজার ৬০০ হাত। এক থেকে দেড় লাখ টাকা মূল্যের একেকটি জালের সঙ্গে ২০ থেকে ২৫ জন জেলে জড়িত। দিনে যাঁরা মাছ ধরেন, তাঁরা সকাল ১০টার দিকে হাওরে নামেন এবং বিকেল ৫টা পর্যন্ত মাছ ধরেন। তবে রাত হলেই বেশির ভাগ জেলে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। সন্ধ্যা সাতটার দিকে হাওরের বিভিন্ন প্রান্ত দিয়ে জেলেরা জাল ফেলেন। ভোর তিনটা-চারটা পর্যন্ত তাঁদের মাছ ধরা চলে।
জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেড় জালে পুঁটি, টেংরা, চাপিলা, পাবদা, বাইন, চাঁদা, কাকিয়া, মেনি, দারকিনা, রানি, চটি, শিং, মাগুর, রুই, কাতলা, বোয়ালসহ বিভিন্ন জাতের মাছ ধরা পড়ে। ভোররাতেই বিভিন্ন অস্থায়ী ঘাটে এই মাছ নিতে দূরদূরান্তের পাইকারেরা চলে আসেন। কিছু মাছ সকাল বেলায় জেলা সদরের আড়তে পাঠানো হয়। কিছু মাছ খুচরা বিক্রেতারা বিভিন্ন গ্রাম-শহরে নিয়ে বিক্রি করেন। এ ছাড়া নিষিদ্ধ প্রচুর কারেন্ট জালও আছে। অনেক স্থানে কারেন্ট জাল দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই ফেলে রাখা হয়।
বেড় জালকে টানা জালও বলা হয় বলে জানান এক জেলে। নাম প্রকাশ না করার শতে৴ এই জেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেড় জালে পানির সব মাছ হুরিয়া আইয়া (ঝাড় দেওয়ার মতো পরিষ্কার হয়ে আসে)। মাঝেমধে৵ মৎস্য বিভাগ এই জাল দিয়া মাছ ধরতে নিষেধ করে। অন্যান্য বছর বেশি অভিযান অইছে (হয়েছে)। এবার দুই-তিনবার গেছে।’
জেলেরা বলছেন, বেড় জাল ও কারেন্ট জালে বেশি মাছ মিলে। এবার মাছও বেশি মিলছে। তাঁদের একমাত্র জীবিকা মাছ ধরা। এ কারণে নিষিদ্ধ জেনেও তাঁরা এই জালে মাছ ধরছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজনগর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) আলতাফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বেড় জালে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীও চলে আসে। কিন্তু মুশকিল হলো তাঁরা রাতের বেলা এই জাল দিয়ে মাছ ধরে। দিনে হাওর খালিই থাকে। রাতে হওয়ায় তাদের হাতেনাতে ধরা যায় না। এই জাল মাছের বংশ ও হাওরের পরিবেশ ধ্বংস করছে।
এবার জালের সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখ করে আলতাফ হোসেন বলেন, জেলেদের সচেতনতা বাড়াতে মাইকিং ও লিফলেট বিতরণ করা
হচ্ছে। শিগগির জেলা প্রশাসন ও জেলা মৎস্য বিভাগ থেকে বড় অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।