ছেলের শোকে কেঁপে কেঁপে উঠছেন আবদুল কাদের

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মো. জোবাইরের বাবা আবদুল কাদের ছেলের শোকে কান্নার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন। জোবাইরের দুই অবুঝ শিশু এখনো জানে না বাবার কি হয়েছে। আজ সকালে লোহাগাড়ার চুনতি ইউনিয়নের হানিফারপাড়া এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

চারদিকে শোরগোল। বাড়ির কেউ মারা গেলে যেমন পরিবেশ দেখা যায়, তেমনই। এর মধ্যে উঠানের এক কোণে চুপচাপ হুইলচেয়ারে বসেছিলেন বৃদ্ধ আবদুল কাদের। বছর তিনেক আগে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে দুই পা কেটে ফেলতে হয়েছে তাঁর। তার ওপর নানা রোগে আক্রান্ত তিনি। এ জন্য কান্নার শক্তিটুকুও যেন নেই। ছেলের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর থেকেই নীরবে চোখের পানি ফেলছেন। বোবা কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠছেন একটু পরপরই।

গতকাল সোমবার বেলা সাড়ে তিনটায় উপজেলার পদুয়া নয়াপাড়া এলাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান আবদুল কাদেরের ছেলে মো. জোবাইর (২৬)। দুর্ঘটনায় জোবাইরের দুই সঙ্গী উপজেলার নয়াপাড়ার জালাল আহমদের ছেলে নুরুল আবছার (৩৭) ও রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দক্ষিণ রাজানগর এলাকার বাবুল মিয়ার ছেলে মো. জাহেদও (২৭) মারা যান। মোটরসাইকেলে থাকা তিন তরুণকে একটি ট্রাক চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁদের।

উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের হানিফারপাড়া এলাকায় জোবাইরদের বাড়ি। আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে ওই বাড়িতে দেখা যায়, লোকজনের ভিড়ে জোবাইরের দুই অবুঝ সন্তান মো. জায়েদ ও মো. রায়েদ এখনো বুঝতে পারেনি বাবার কী হয়েছে। আঙিনার এক জায়গায় বসে লোকজনের আনাগোনা দেখছিল তারা।

কথা হয় তাঁর বড় ভাই মো. সোহেলের সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি জানান, পরিবারে চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে জোবাইর তৃতীয়। চার বছর আগে চাচাতো বোন রমি আক্তারের সঙ্গে বিয়ে হয় জোবাইরের। জোবাইর চকরিয়া উপজেলায় ঝাড়ুর ব্যবসা করতেন। সেই সুবাদে স্ত্রীকে নিয়ে চকরিয়ায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। সোমবার বিকেলে বান্দরবান থেকে কেরানীহাটে আসা ঝাড়ু দেখতে যাচ্ছিলেন তিনি। যাওয়ার পথেই এমন দুর্ঘটনা ঘটে।

সহায়–সম্পত্তি বলতে তেমন কিছু নেই জোবাইরের। চকরিয়ার বানিয়ারছড়ায় ঝাড়ুফুলের আড়ত ছিল তাঁর। ঝাড়ুর ব্যবসা করে লাভের মুখও দেখছিলেন তিনি। ধীরে ধীরে ব্যবসা আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা ছিল তাঁর। কিন্তু তার আগেই সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছেন তিনি।  

জোবাইরের আকস্মিক মৃত্যুতে দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে কীভাবে বাঁচবেন, ভেবে পাচ্ছেন না স্ত্রী রমি আক্তার। রমি বললেন, ছোট সংসারে তেমন অভাব-অভিযোগ ছিল না। জোবাইর স্বপ্ন দেখতেন বড় কিছু করার। তা আর কখনো হবে না। এখন দুই ছেলেকে নিয়ে কী করবেন, তা জানেন না রমি।

জানা গেল, সোমবার দুপুরের খাবার খেয়ে অন্য এক বন্ধুর মোটরসাইকেল নিয়ে চকরিয়া থেকে সাতকানিয়ার কেরানীহাটের দিকে রওনা দেন জোবাইর। সঙ্গে নেন রাঙ্গুনিয়া থেকে আসা তাঁর দূরসম্পর্কের ফুপাতো ভাই মো. জাহেদকে। কেরানীহাটে যাওয়ার পথে লোহাগাড়ার পদুয়া বাজার থেকে মোটরসাইকেলে ওঠেন জোবাইরের আরেক বন্ধু নুরুল আবছার। পদুয়া বাজার থেকে এক কিলোমিটার দূরে নয়াপাড়া এলাকায় ট্রাকচাপায় ঘটনাস্থলে তিনজনই নিহত হন। দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেলটি দুমড়েমুচড়ে যায়। পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এসে তাঁদের লাশ উদ্ধার করেন।

আজ সকালে উপজেলার পদুয়া নয়াপাড়া এলাকায় গিয়ে কথা হয় দুর্ঘটনায় নিহত নুরুল আবছারের স্ত্রী কলি আক্তারের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রবাসফেরত নুরুল আবছার আট বছর ধরে বেকার। বন্ধু ও পরিচিতজনদের কাছে প্রায় ছয় লাখ টাকা দেনা হয়েছে তাঁর। বন্ধু জোবাইরের সঙ্গে ঝাড়ুর ব্যবসা শুরু করে সংসারের হাল ধরতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দুর্ঘটনায় নিমেষেই সব শেষ হয়ে গেল।

কলি আক্তার আরও জানান, তাঁদের দুই ছেলেসন্তানের মধ্যে মো. আনাস (১০) হেফজখানায় পড়ে আর মো. জুরাইসের (৫) এ বছর স্কুলে যাওয়ার কথা ছিল। এখন দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত তিনি।

সোমবার দিবাগত রাতে নিহত দুজনের পৃথক জানাজা শেষে সামাজিক কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন হয়।

দোহাজারী হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খান মোহাম্মদ এরফান প্রথম আলোকে বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়। পরে নিহত তিনজনের লাশ ও দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ি দুটি থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। তবে ট্রাকচালক ও তাঁর সহকারী পালিয়ে গেছেন। পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনজনের লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।