ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন

বনের জায়গা দখল করে এভাবে বাঁধ দিয়ে তৈরি করা হয় হ্রদ। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়া ও সাতকানিয়া উপজেলার সোনাকানিয়া ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী এলাকায় হ্রদের একাংশ ছবিফাইল ছবি

চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বড় হাতিয়া ও সাতকানিয়া উপজেলার সোনাকানিয়া সীমান্তবর্তী এলাকায় পাহাড়ি ছড়ায় বাঁধ দিয়ে কৃত্রিম হ্রদ সৃষ্টির ঘটনায় বনের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে ৯ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে বন অধিদপ্তর।

গতকাল সোমবার বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কমিটি গঠনের বিষয়টি জানানো হয়। কমিটিতে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক বিপুল কৃষ্ণ দাশকে সভাপতি ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুনকে সদস্য করা হয়। ওই বিজ্ঞপ্তিতে কমিটিকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে বিস্তারিত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

কমিটির সদস্যসচিব ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামীকাল বুধবার বেলা আড়াইটায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষকের কার্যালয়ে কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হবে। ওই সভায় কমিটির সদস্যরা কর্মপন্থা চূড়ান্ত করবেন। সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনে অবৈধভাবে বাঁধ দেওয়ার ফলে জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত বনকে কীভাবে পুনর্গঠন করে আগের প্রাকৃতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা যায়, সেই বিষয়ে সুপারিশ করবে কমিটি।

গত শনিবার প্রথম আলোতে ‘বন ডুবিয়ে প্রভাবশালীদের হ্রদ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বাঁধ নির্মাণের সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম এবং বাঁধের কারণে বন, পাহাড় ও কৃষিজমির ক্ষতির চিত্র তুলে ধরা হয়। বন বিভাগের দাবি, তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর আইনি প্রক্রিয়া শুরু করলেও সদ্য সাবেক স্থানীয় সংসদ সদস্য (চট্টগ্রাম-১৫) আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দীন নদভীর কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়।

এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর শনিবার বিকেলেই বাঁধ কাটার কাজ শুরু করে বন বিভাগ। সন্ধ্যায় বাঁধের মাঝ বরাবর কেটে দিলে পানিপ্রবাহ শুরু হয়। আর রাত সাড়ে ৯টার মধ্যে বাঁধটি পুরোপুরি অপসারণ করা হয়। এরপর মধ্যরাতেই কৃত্রিম হ্রদের পানি নেমে যায়। যেখান থেকে পানি নেমে গেছে, সেখানে বন ধ্বংসের চিত্র উঠে এসেছে। পানিতে ডুবে থাকা গাছগুলোর মধ্যে প্রাণ নেই। মরা গাছগুলো মৃত ডালপালা নিয়ে কোনো রকম দাঁড়িয়ে আছে। হ্রদের কারণে পানি জমে থাকায় পাহাড়গুলোর মাটি ধসে পড়েছে। চোখে পড়ল হ্রদের বিস্তৃতি বাড়ানোর জন্য পাহাড় কাটার দৃশ্যও।
বন বিভাগ বলছে, হ্রদ তৈরির কারণে গামারি, সেগুন, চিকরাশি, অর্জুনসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় প্রায় পাঁচ লাখ গাছ মারা গেছে। ডুবে যাওয়া জায়গার মধ্যে বন্য হাতির চলাচলের পথ ছিল। নানা প্রজাতির প্রাণী বাস করত সেখানে।

বাঁধ কেটে দেওয়ায় হ্রদের পানি নেমে গেছে। এখন সেখানে আবার বনায়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে বন বিভাগের। চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, চলতি অর্থবছরে বাজেটের স্বল্পতা রয়েছে। তবে আগামী অর্থবছরে হ্রদ এলাকায় বনায়ন করা হবে। আবার যাতে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল গড়ে ওঠে এবং হাতি চলাচলের পথ সচল হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

এদিকে ধ্বংস হয়ে যাওয়া বন পুনরুদ্ধারে অতি দ্রুত বনায়নের পরামর্শ দিয়েছেন বন গবেষকেরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বনবিদ্যা ও পরিবেশবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক মো. কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাঁধ কেটে দেওয়ায় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরেছে, এটা খুবই আশার কথা। আর যে অবস্থা তাতে কদম, জারুলসহ নানা ধরনের গাছ লাগানো যেতে পারে। বিলুপ্ত ও বিপন্নপ্রায় বৈলাম, গর্জন, চাপালিশসহ স্থানীয় পরিবেশ উপযোগী গাছের চারা রোপণ করা দরকার। আর বাঁশের চারা রোপণ করা দরকার। বাঁশ যেমন মাটি ধরে রাখবে, তেমনি হাতির খাবারের জোগান দেবে। এসব পদক্ষেপ নেওয়া হলে অবক্ষয়প্রাপ্ত বন আবার ফিরে আসবে। একই সঙ্গে হাতি ও বন্য প্রাণী, জীবজন্তুর আবাস গড়ে উঠবে।