৫০ পেরিয়েও যে বন্ধুতা অটুট আজও
স্কুলজীবনের ছোট পরিসর পেরিয়ে তাঁরা কলেজের বড় আঙিনায় পা রেখেছিলেন ১৯৭৫ সালে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা নতুন মুখের সঙ্গে পরিচয়। তারপর বন্ধুতা। এরপর মহাকালের গর্ভে অর্ধশতাব্দীকাল কেটে গেল। কিন্তু সেই বন্ধুতায় মরচে ধরেনি।
দুটি বছর তাঁরা একসঙ্গে কাটিয়েছেন ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কলেজে। ১৯৭৭ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে দেশের নানা প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। শিক্ষাজীবন শেষে নানা পেশায় জড়িত হয়ে কীর্তিমান মানুষগুলো যে যাঁর ক্ষেত্রে হয়েছেন খ্যাতিমান। কেউ এখন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিল্পপতি, অধ্যাপক, ব্যবসায়ী, সৈনিক, নাবিক, আমলা, গায়ক, শিল্পী, কথাসাহিত্যিক, কবি বা সাংবাদিক। তাঁরা সবাই চট্টগ্রাম কলেজের ১৯৭৭ সালের এইচএসসি ব্যাচের শিক্ষার্থী।
‘ভালোবাসার ৭৭’ নামের সংগঠনের মধ্য দিয়ে তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে ভরা সেই দিনগুলো আবার ফিরিয়ে আনতে চাইলেন তাঁরা। জীবনের অবসরবেলায় বন্ধুতার বন্ধুন ঝালিয়ে নিলেন আরও একবার। ২০২৫ সাল তাঁদের বন্ধুতার সুবর্ণজয়ন্তী। এ উপলক্ষে ‘ভালোবাসার ৭৭’ আয়োজন করেছিল প্রাক্তনদের পুনর্মিলনী। ১০ থেকে ১২ জানুয়ারি—তিন দিনের এই পুনর্মিলনী আয়োজিত হয় কক্সবাজারে।
আয়োজকদের অন্যতম একজন নৌ প্রকৌশলী এস এম এ হান্নান বলেন, ‘এবারের আয়োজনটা বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, এ বছর আমাদের বন্ধুতার ৫০ বছর পার হয়েছে। বয়স যত বাড়ছে, আমাদের তারুণ্য তত বাড়ছে। যৌবনের শক্তি, কাজের প্রেরণা আমরা ধরে রেখে প্রচলিত ধারণাকে ম্লান করে দিতে চাই। ’
‘ভালোবাসার ৭৭’–এর অন্যতম সদস্য দেশবরেণ্য কণ্ঠশিল্পী নকীব খান। তাঁকেও পাওয়া গেল এই পুনর্মিলনীতে। নকীব যেন ফিরে গেলেন কলেজজীবনে। বললেন, ‘চট্টগ্রাম কলেজের দিনগুলো ছিল অসামান্য সৃজনশীল একসময়। জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি আমরা মগ্ন ছিলাম সৃষ্টিশীল কাজে। তখন অনেক বিখ্যাত গান রচিত হয়েছে চট্টগ্রাম কলেজে।’
নকীব খানের কাছ থেকে জানা গেল, সোলস এবং কুমার বিশ্বজিতের গাওয়া গান ‘তোরে পুতুলের মতো সাজিয়ে’ গানটি শ্রেণিকক্ষে বসে লিখেছেন তাঁর সহপাঠী বন্ধু আবদুল্লাহ আল মামুন। ‘এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে’র মতো বিখ্যাত গানটিও ওই সময়ে তিনি লিখেছিলেন। সেই সেরা দিনগুলোকে স্মরণ করতে কক্সবাজার এসেছেন বলে জানালেন তিনি।
তিন দিনের আয়োজনের দ্বিতীয় দিন নকীব খান গান পরিবেশন করে মাতিয়ে রেখেছিলেন সবাইকে। বন্ধুতার টানে কানাডা থেকে চলে এসেছেন মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছেন রাফি চৌধুরী, আজম চৌধুরী, ওয়াজিউল্লাহ, আবুল মনসুর খান, মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছিলেন খোরশেদ আলম। তাঁরা জানালেন, ‘হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এসে মনে হলো নিজের জীবনটাকে ফিরে পেলাম।’
আয়োজকদের অন্যতম নজমুল আলম চৌধুরী জানালেন, ‘তিন দিনের কক্সবাজার ভ্রমণকে উপভোগ্য ও বন্ধুতার সুবর্ণজয়ন্তীকে স্মরণীয় করতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও সৈকতে নানা ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। মেজবানেরও ব্যবস্থা ছিল। আমাদের বন্ধুরাই এসব আয়োজনের স্পন্সর করেছেন।’
‘ভালোবাসার ৭৭’–এর আরেক সতীর্থ শিল্পপতি শাহাবুদ্দীন আলম বলেন, ‘ইতিমধ্যে অনেক বন্ধুকে আমরা হারিয়েছি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কার কখন ডাক আসে ঠিক নেই। এমন একটি পর্যায়ে এই সম্মিলন আমাদের কাছে সঞ্জীবনীর মতো।’
শনিবার পৌষের বিকেলে সৈকতে দাঁড়িয়ে আরেক প্রাক্তন ছাত্র এ টি এম আফতাব উদ্দীন বললেন, ‘জীবিকার তাগিদে আমরা এত দিন কে কোথায় ছিটকে গিয়েছিলাম। এখন সমুদ্রের পাড়ে এসে মহাজীবনের স্বাদ অনুভব করছি। প্রিয় মুখগুলোর সঙ্গে তিনটা দিন কাটালাম। এমন সুযোগ জীবনে সব সময় আসে না।’