হাওরকে হাওরের মতো থাকতে দিতে হবে

কাসমির রেজা

অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও হাওর ধুঁকছে। প্রায়ই অকালবন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে হাওরাঞ্চলের একমাত্র বেরো ফসল। নানা সংকটের কারণে হাওর তার নিজস্বতা হারাচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে হাওরাঞ্চলের তরুণদের নিয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজার সঙ্গে। সিলেটের একটি কলেজের এই শিক্ষক এক যুগ ধরে হাওরাঞ্চলের পরিবেশ ও জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছেন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১১ সেপ্টেম্বর পেয়েছেন শেখ হাসিনা ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড।  

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও হাওর ধুঁকছে। এর কারণ কী?

কাসমির রেজা: হাওর প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। কিছু কার্যকর পদক্ষেপ ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে হাওরের এ সম্পদকে আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। বছরে ছয় মাস যে বিস্তীর্ণ জলরাশি থাকে, তা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে দেশের মাছের উৎপাদন দ্বিগুণ হবে। অকালবন্যায় হাওরে ফসলহানি না ঘটলে দেশে খাদ্যঘাটতি দেখা দেবে না। হাওরাঞ্চলের নদী ও বিলগুলো সারা বছর আমাদের মাছের চাহিদা পূরণ করতে পারত। পরিবেশসম্মত পর্যটন গড়ে তুলতে পারলে মানুষের আয়রোজগার বাড়ত। হাওরের মানুষের জীবনমান আরও উন্নত হতে পারত। মূলত, সময়োপযোগী পরিকল্পনা ও আন্তরিক প্রচেষ্টার অভাব রয়েছে। এ কারণে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও হাওর ধুঁকছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত রাস্তা, কালভার্ট, স্লুইসগেট ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং জলবায়ুর প্রভাবে হাওর নিজস্বতা হারাচ্ছে...

কাসমির রেজা: হাওর এলাকার পরিবেশ ও প্রকৃতি অত্যন্ত নাজুক। যেখানে-সেখানে রাস্তাঘাট তৈরি করে বা বাঁধ দিয়ে হাওরের স্বাভাবিকতা নষ্ট করা হচ্ছে। এর ক্ষতিকর প্রভাবে হাওরের সম্পদ নষ্ট হচ্ছে, মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। হাওরকে হাওরের মতো থাকতে দিতে হবে। এখনই হাওরের ওপর অযাচিত উৎপাত বন্ধ না করলে এর জন্য ভবিষ্যতে বড় মাশুল দিতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হাওর এলাকা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বছর বছর অকালবন্যায় ফসলহানি, নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া, বজ্রপাতে মৃত্যু, ফসলে রোগবালাই—সবকিছুতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষ দূত ইয়ান ফ্রাই ৭ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জ ভ্রমণ করেছেন। তাঁকে আমরা ২৬ দফা প্রস্তাব দিয়েছি। তিনি স্বীকার করেছেন যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হাওর এলাকা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক জলবায়ু ফান্ড থেকে হাওরের ন্যায্য হিস্যা আমরা আদায় করতে পারছি না।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ধান ও মাছ—এ দুটোই হাওরের মূল সম্পদ। কিন্তু এসব সম্পদের উৎপাদন বাড়াতে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ খুব একটা দেখা যায় না বলে কৃষক ও জেলেদের অভিযোগ আছে। আপনি কী বলবেন?

কাসমির রেজা: মাছের উৎপাদন বাড়াতে হাওরে কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া খুব জরুরি। হাওরে প্রজননের সময়ে দুই মাস মাছ ধরা বন্ধ রাখতে পারলে মাছের উৎপাদন বহুগুণ বেড়ে যাবে। এ সময় উপকূলের মতো হাওরের জেলেদের প্রণোদনা দিতে হবে। এ দাবি আমরা দীর্ঘদিন থেকে করে আসছি। এ ছাড়া হাওরে অবৈধ কোনা জাল ও কারেন্ট জাল দিয়ে অবাধে মাছ ধরা হচ্ছে। এসব বন্ধ করতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা দরকার। কালেভদ্রে অভিযান চালানো হয়, ফলে এর প্রভাব সেভাবে পড়ছে না। হাওরে অধিক পরিমাণে মাছের পোনা অবমুক্ত করাও জরুরি।

ধানের ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি ও পানিসহনীয় উচ্চফলনশীল জাতের কথা অনেক দিন ধরে শুনে আসছি, কিন্তু বাস্তবায়ন দেখছি না। হাওর রক্ষা বাঁধের জন্য অর্থ বরাদ্দ বিলম্বে হয়। নীতিমালা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট হাওরের কৃষকেরা হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ করবেন আর সরকার অর্থ দেবে। কিন্তু সময়মতো টাকা না পেলে কৃষক সময়মতো বাঁধ দেবেন কীভাবে? এখন তো এক বছরের টাকা পেতে আরেক বছর চলে আসে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: হাওরের পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় কী কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?

কাসমির রেজা: হাওরের পরিবেশকে আগের জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। নদী ও বিলগুলো খনন করা আবশ্যক। পর্যটন হাওরের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সুপরিকল্পিত ও পরিবেশসম্মত পর্যটন গড়ে তুলতে হবে। প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করতে হবে। এ জন্য পর্যটকদের পাশাপাশি নৌকার মাঝি ও এলাকাবাসীকে সচেতন হতে হবে। হাওরে পরিবেশসম্মত কৃষি চালু রাখতে হবে। অবাধে সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা যাবে না। অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। হাওরে অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ তথা প্রকৃতির ওপর অত্যাচার বন্ধ করতে হলে বিকল্প কর্মসংস্থানের ও বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: অকালবন্যায় প্রায় প্রতিবছরই হাওরের একমাত্র বোরো ফসল তলিয়ে যাচ্ছে। কখনো বাঁধ ভেঙে ফসল তলাচ্ছে। নিম্ন মানের কাজ আর অনিয়মের কারণে বাঁধ ভাঙছে বলেও অভিযোগ আছে। সার্বিক বিষয়ে আপনার অভিমত কী?

কাসমির রেজা: গত ২০ বছরে হাওরে অকালবন্যায় আটবার ফসলহানি ঘটেছে। ২০১৭ সালের বন্যায় ব্যাপক ফসলহানির পর হাওরবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাঁধের নীতিমালায় পরিবর্তন এসেছে। এখন ‘কাবিটা নীতিমালা ২০১৭’-এর আওতায় ঠিকাদারের পরিবর্তে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে বাঁধ দেওয়া হয়। কিন্তু নীতিমালা সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয় না। ১৫ ডিসেম্বর থেকে বাঁধের কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বেশির ভাগ কাজই শুরু হয় ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে। এতে নির্ধারিত ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ হয় না। নীতিমালা অমান্য করে বাঁধের কাছ থেকে মাটি নেওয়া, ঢাল বজায় না রাখা ইত্যাদি কারণে বাঁধ দুর্বল হয়। নরম মাটি পানির চাপ সহ্য করতে পারে না। তবে এ কথা সত্য যে ঠিকাদারি প্রথার চেয়ে নতুন নীতিমালা অনুযায়ী বাঁধ ভালো হচ্ছে। তা না হলে এবারের অকালবন্যায় আরও বেশি ফসলের ক্ষতি হতো।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: কয়েক বছর ধরে হাওরে বজ্রপাতে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছেন। এ থেকে সুরক্ষার উপায় কী?

কাসমির রেজা: মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, মার্চ থেকে মে মাসে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলে। বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। এ থেকে বাঁচার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। গভীর হাওরে উঁচু কোনো গাছপালা বা স্থাপনা না থাকায় বজ্রপাত সরাসরি মানুষের ওপর আঘাত হানে।

তাই গভীর হাওরে হাওরের উপযোগী গাছ রোপণ ও বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আমরা বিদ্যুতের খুঁটিগুলোকেও কাজে লাগাতে পারি। এর পাশাপাশি বজ্রপাত ও বৃষ্টির সময় কৃষক ও জেলেরা যাতে আশ্রয় নিতে পারেন, সে জন্য গভীর হাওরে ছোট ছোট আশ্রয়কেন্দ্র করা দরকার।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: হাওরের সমস্যাগুলো সমাধানে করণীয় কী? কীভাবে হাওরকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব?

কাসমির রেজা: এ মুহূর্তে হাওরের পরিবেশ রক্ষা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া দরকার। হাওর নিয়ে গবেষণা বাড়াতে হবে। গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের আওতায় সীমান্ত এলাকা থেকে ভৈরব পর্যন্ত সব নদী, খাল ও কিছু বিল পুনঃখনন করতে হবে। হাওরের সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে নীতিনির্ধারকদের হাওরের বিষয়ে জ্ঞান রাখতে হবে এবং আন্তরিক হতে হবে।