ইউটিউব দেখে মুরগি পালন, বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থীর মাসে আয় লাখ টাকা

নিজের মুরগির খামারে সাইদুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

করোনা মহামারির সময় ২০২০ সালে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে। ওই সময় হাতে কোনো কাজ ছিল না সাইদুল ইসলামের। কিন্তু অলস হয়ে বসে থাকতেও ভালো লাগছিল না তাঁর। হঠাৎ একদিন তাঁর মাথায় মুরগি পালনের চিন্তা আসে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে মুরগির খামার করবেন, বিষয়টি কেমন হবে? এ নিয়ে দ্বিধার মধ্যে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত বন্ধুদের পরামর্শে মুরগির খামার। ইউটিউবে মুরগি পালনের পদ্ধতি ও পরিচর্যার কৌশল শিখে সেভাবেই কাজ করেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দুই বছরের ব্যবধানে ঘুরে যায় তাঁর ভাগ্যের চাকা। এখন প্রতি মাসে তাঁর আয় লাখ টাকা।

নরসিংদীর মাধবদী থানার চরদিঘলদী ইউনিয়নের আড়াই আনী গ্রামে সাইদুল ইসলামের বাড়ি। বর্তমানে পড়াশোনা করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষে। তিনি নরসিংদীর গুলেস্তা হাফিজ মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও আব্দুল কাদির মোল্লা সিটি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন।

করোনাকালে মানুষ যখন কাজ হারাচ্ছিলেন, তখন প্রথম দফায় ১৫ হাজার টাকা লাভ করেন সাইদুল ইসলাম। সেই থেকে মুনাফা শুরু। তারপর আর থেমে থাকতে হয়নি। ধীরে ধীরে খামারের পরিসর বাড়ে, মুনাফার পরিমাণও বাড়তে থাকে।

শুরুটা মোটেই সহজ ছিল না। অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে ও প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে এগিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে। এ বিষয়ে তরুণ উদ্যোক্তা সাইদুল ইসলাম বলেন, শুরুটা ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। কোভিড-১৯–এর কারণে অনেক মানুষের চাকরি চলে যাচ্ছিল। তাঁর দুই ভাই তখন বিদেশে থাকতেন। তাঁরাও কাজ হারান। বাবাহীন পরিবারে তখন টানাপোড়েন চলছিল। হাত খরচের টাকা মায়ের কাছে চাইতে লজ্জা লাগত। বিশ্ববিদ্যালয়ের একের পর এক ছুটি বাড়তে থাকায় অলস সময় পার করছিলেন। তখন একই ইউনিয়নের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বন্ধুর পরামর্শে মুরগি পালন করার চিন্তা করেন। তবে পোলট্রি নাকি সোনালি মুরগির খামার দেবেন, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন। পরে তিনি পোলট্রি মুরগি পালন শুরু করলেন। আর তাঁর তিন বন্ধু যৌথভাবে শুরু করেন সোনালি মুরগির খামার।

পরিবারের সহায়তায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকার পুঁজি নিয়ে বাড়ির পাশের পরিত্যক্ত তাঁতকলের ঘরে ব্রয়লার মুরগি পালন শুরু করেন সাইদুল ইসলাম। করোনাকালে মানুষ যখন কাজ হারাচ্ছিলেন, তখন প্রথম দফায় ১৫ হাজার টাকা লাভ করেন তিনি। সেই থেকে মুনাফা শুরু। তারপর আর থেমে থাকতে হয়নি। ধীরে ধীরে খামারের পরিসর বাড়ে, মুনাফার পরিমাণও বাড়তে থাকে। বর্তমানে তিনটি শেডে প্রায় ৩ হাজার মুরগি পালন করছেন। এই উদ্যোগ যেমন তাঁর পরিবারে সচ্ছলতা এনেছে, তেমনি নরসিংদীর প্রত্যন্ত এলাকায় মাংসের চাহিদাও পূরণ করছে। বর্তমানে সব মিলিয়ে তাঁর এখন প্রতি মাসে আয় হয় লাখ টাকার বেশি।

নিজের মুরগির খামারে কাজ করছেন সাইদুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘কিছু প্রতিবন্ধকতার কথা মাথায় নিয়ে মুরগির খামার করার সিদ্ধান্ত নেন। খামার থেকেই আমার জীবনের প্রথম উপার্জন। আমার সঙ্গে অন্য তিন বন্ধু যৌথভাবে খামার দিয়েছিল, তারা লোকসান গুনে খামার বন্ধ করে দিয়েছে।’
করোনার প্রভাব কমে এলে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হয়। সাইদুল চলে আসেন ক্যাম্পাসে। তখন খামার দেখাশোনা করেন সাইদুলের মেজ ভাই আবু সিদ্দিক। তিনি বিদেশ থেকে আসার পর দুর্ঘটনায় পা ভেঙে যায়। তারপর আর তাঁর বিদেশ যাওয়া হয়নি। সাইদুল এখন রাজশাহীতে বসেই মুঠোফোনে তাঁকে দিকনির্দেশনা ও বিভিন্ন পরামর্শ দেন। পড়াশোনা শেষ করে ভবিষ্যতে যে পেশাতেই থাকেন, পাশাপাশি মুরগির খামারটি রাখবেন। খামার আরও বড় করে মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করার ইচ্ছা আছে সাইদুলের।

সাইদুলের মেজ ভাই আবু সিদ্দিক খামার দেখাশোনার পাশাপাশি কাঠের ব্যবসা করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথমে আমরা সাইদুলের ওপর ভরসা করতে পারছিলাম না। সাইদুল অনেক বুঝিয়ে আমাদের রাজি করে। পরে ধীরে ধীরে আমাদের ভাগ্যের চাকা খুলতে থাকে। প্রতি মাসে এখন লাখ টাকারও বেশি আয় হয়। আল্লাহর রহমতে, এখন আমরা অনেক ভালো আছি। আমরা সাইদুলকে নিয়ে গর্বিত।’

আমি ও আমার পরিবারের কারও মুরগির খামার করার অভিজ্ঞতা ছিল না। ইউটিউবে ভিডিও দেখে ও পাশের এলাকার খামারে ঘুরে ঘুরে মুরগি পালনের বিষয়টি জানেন।
সাইদুল ইসলাম, শিক্ষার্থী ও খামারি

সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ও আমার পরিবারের কারও মুরগির খামার করার অভিজ্ঞতা ছিল না। ইউটিউবে ভিডিও দেখে ও পাশের এলাকার খামারে ঘুরে ঘুরে মুরগি পালনের বিষয়টি জানেন। মুরগির অসুখ হলে কোন ওষুধ দিতে হয়, এসব টিউটোরিয়াল ভিডিও অনলাইনে বেশি দেখতাম।’

পরিবার ও গ্রামাঞ্চলের লোকজন প্রথমে মুরগির খামার করার উদ্যোগটি ভালোভাবে নেননি বলে জানান সাইদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘নিজের পরিবারের লোকজনই প্রথমে ভরসা করতে চাননি। পরে অনেক বুঝিয়ে তাঁদের রাজি করাই। গ্রামের মানুষও বাঁকা চোখে দেখতেন। বর্তমানে পরিবারের সদস্যের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। খামারে দুজনের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। পাশাপাশি সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টেছে।’

একই গ্রামের বাসিন্দা ও ঢাকার মতিঝিলের পূবালী ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্য শাখার সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার সায়েদ আব্দুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাকালে সাইদুল প্রায়ই আমার কাছে আসত। আমারও একটি খামার আছে। আমি তাকে এ ব্যাপারে অনেক উৎসাহ দিয়েছি। এখন সে সফল খামারি। তার মতো ছেলেরা পড়াশোনার পাশাপাশি এমন উদ্যোগ গ্রহণ করলে, আমাদের দেশের বেকার সমস্যা অনেকটা কমে আসবে।’