চুইঝাল চাষে সাফল্য পেয়ে প্রবাসফেরত শাহ আলম বললেন, ‘আর বিদেশে যাব না’

খেত থেকে চুইঝাল সংগ্রহ করছেন শাহ আলম (বাঁয়ে)। তাঁকে সহায়তা করছেন আরও কয়েকজন। সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার শিয়ালকোল ইউনিয়নের নিয়ামতপুর গ্রামেছবি: প্রথম আলো

সিরাজগঞ্জে বাণিজ্যিকভাবে চুইঝাল চাষ করে সাফল্যের দেখা পেয়েছেন বিদেশফেরত এক ব্যক্তি। জেলায় মসলাজাতীয় ফসল চুইঝালের সফল বাণিজ্যিক চাষ এটিই প্রথম। এই সফলতায় বর্তমানে এলাকার কৃষক, তরুণ ও যুবকেরা চুইঝাল চাষ করতে আগ্রহী হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

ওই ব্যক্তির নাম শাহ আলম (৪৫)। তিনি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার শিয়ালকোল ইউনিয়নের নিয়ামতপুর গ্রামের শুকুর আলীর বড় ছেলে। প্রায় এক যুগ সৌদি আরবে প্রবাসজীবন কাটিয়ে গ্রামে ফিরে ২০২২ সালে সিরাজগঞ্জে চুইঝাল চাষের উদ্যোগ নেন তিনি।

সম্প্রতি এক দুপুরে শাহ আলমের চুইঝালের খেতে গিয়ে দেখা যায়, জমি থেকে ফসল উত্তোলন করা হচ্ছে। বেশ কিছু স্থানে সমূলে চুইঝাল গাছগুলো তুলে বিভিন্ন স্থানে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। খুলনাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকারেরা গিয়ে এসব চুইঝাল কিনে নিচ্ছেন।

জানতে চাইলে শাহ আলম বলেন, ‘বিদেশে থাকা অবস্থাতেই ইউটিউবে খুলনা এলাকায় চুইঝাল চাষে কৃষকদের সফলতা দেখে আমার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে খুলনা এলাকায় চুইঝালের চারা উৎপাদকারী একটি নার্সারির মালিকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি আমাকে বেশ উদ্বুদ্ধ করেছেন। এরপর দেশে ফিরে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সমন্বিত কৃষি ইউনিটের (কৃষি খাত) আওতায় উচ্চমূল্যের মসলাজাতীয় ফসল উৎপাদন প্রদর্শনী বাস্তবায়নকারী স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (এনডিপি) সহায়তায় চুইঝালের চাষ শুরু করি। ২০২২ সালের ৩০ আগস্ট বাড়ির পাশে ৩৩ শতক জমি ৩ বছরের জন্য ৬০ হাজার টাকায় ইজারা নিয়ে এগুলোর চাষ শুরু করা হয়।’

শাহ আলমের দাবি, চুইঝাল চাষ শুরু থেকে এ পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার টাকা। অন্যদিকে চলতি বছর দুই ধাপে ৭ লাখ ৩৭ হাজার টাকার চুইঝাল বিক্রি করেছেন।

সিরাজগঞ্জে বাণিজ্যিকভাবে চুইঝাল চাষ করে সফল হওয়ার দাবি করেছেন প্রবাসফেরত শাহ আলম
ছবি: প্রথম আলো
আরও পড়ুন

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চুইঝাল একটি লতাজাতীয় মসলা, যা প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন ঔষধিগুণে পরিপূর্ণ। বাংলাদেশের খুলনা, যশোর, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় চুইঝাল বহুল পরিচিত এবং সেখানেই দেশের এটির অধিকাংশ চাষ হয়। মসলাটি রান্নায়, বিশেষত মাংসের সঙ্গে ব্যবহৃত হয় এবং এতে আর মরিচের প্রয়োজন হয় না। এ ছাড়া এটি ভেষজ পথ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পুষ্টিবিদ আবদুল মজিদ বলেন, চুইঝাল গ্যাস্ট্রিক সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূরে করে। খাবারের রুচি বৃদ্ধি করে ও ক্ষুধামান্দ্যও দূর করে। এ ছাড়া এটি কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে হৃদ্‌রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে আরও জানা যায়, দেশে দুই ধরনের চুইঝালের চাষ হয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে গেছো চুইঝাল। এটি সাধারণত অন্য গাছের সঙ্গে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বড় হয়ে থাকে। অন্যটি হচ্ছে ঝাড় চুইঝাল। এটি সাধারণত জমিতে ঝাড় আকারে চাষ হয়ে থাকে। দামের দিক থেকে এই ঝাড় চুইঝালের দাম তুলনামূলক বেশি। প্রতি কেজি কাঁচা চুইঝাল ৭০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। শুকনা চুইঝালের দাম আরও বেশি, এগুলো ১ হাজার ৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতে পারে। এক হেক্টর জমিতে ঝাড় চুইঝালের চাষ করে বছরে প্রায় ২ থেকে ২ দশমিক ৫ মেট্রিক টন চুইঝালের ফলন পাওয়া সম্ভব।

দেশের বেকার যুবক ও তরুণদের উদ্দেশে শাহ আলম বলেন, ‘আমি এখন আর বিদেশে যাব না। দেশে থেকেই কৃষিকাজে মনোযোগী হওয়ার ইচ্ছা আছে। দেশের কৃষক, বেকার যুবক ও তরুণেরা চুইঝাল চাষের এগিয়ে এলে অনেক লাভবান হতে পারবেন। দেশ-বিদেশে মসলাজাতীয় এ ফসলের বেশ চাহিদা আছে।’

চাহিদার কারণে চলতি বছর নতুন করে আরও দুই বিঘা জমিতে চুইঝাল চাষের পরিকল্পনা করেছেন শাহ আলম। এর পাশাপাশি তিন বিঘা জমিতে উন্নত জাতের পেঁপের চাষ শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে সেগুলোতেও ফল ধরতে শুরু করেছে।

শাহ্ আলমের চুইঝালের চাষ দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিয়ামতপুর গ্রামের কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী ওমর ফারুক ও ফিরোজ আহমেদ বলেন, তাঁদের বাড়ির পাশেই এমন ফসল চাষ করতে দেখে খুব আগ্রহী হয়েছেন। নিজেদের পরিত্যক্ত জমিতে এই ফসল চাষ করার পরিকল্পনা করছেন।

বিক্রির জন্য সংগৃহীত চুইঝাল প্রস্তুত করছেন শাহ আলম
ছবি: প্রথম আলো

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে চুইঝাল চাষের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে বলে জানান এনডিপির কৃষি বিভাগের ব্যবস্থাপক আবদুল হালিম। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে চুইঝাল। এর জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এটিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন নামে হোটেল ব্যবসার প্রসার ঘটেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিরাজগঞ্জ কার্যালয়ের উপপরিচালক আহসান শহীদ বলেন, জেলায় বেলে-দোআঁশ মাটিতে চুইঝালের সফল বাণিজ্যিক চাষ এটিই প্রথম। বর্তমানে জেলার কৃষক, তরুণ ও যুবকদের মসলাজাতীয় মূল্যবান ফসলটি চাষ করতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন