জমজমাট সীমান্ত হাটে এক দিন

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার সাহিদাবাদ এলাকার সীমান্ত হাটে কেনাকাটা করছেন লোকজন। বুধবার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

হাটে নানা বয়সী মানুষের ভিড়। কেউ ক্রেতা, কেউ বিক্রেতা, কেউবা দর্শনার্থী। দোকানে দোকানে বাহারি পণ্যের সমাহার। ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই ব্যস্ত। নির্ধারিত সময়ে কেনাবেচা, ঘোরাঘুরি—সব শেষ করতে হবে।

সুনামগঞ্জের নতুন সীমান্ত হাটে গত বুধবার দুপুরে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা গেল। খুব বেশি দিন আগে চালু হয়নি, তবে জমে উঠেছে এই হাট। বেচাকেনা দিন দিন বাড়ছে।

মানুষের উপস্থিতি এই হাটে দুই কারণে বেশি। একটা হলো জিনিসপত্র কেনাকাটা; অন্যটি হলো জাদুকাটা নদী, মেঘালয় পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ আর পাশের শাহ আরেফিন (র.)–এর আস্তানা দর্শন। তবে হাটের কিছু উন্নয়নকাজ জরুরি, বলছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা।

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের সাহিদাবাদ ও ভারতের নালিকোটা এলাকায় সীমান্তের শূন্যরেখায় এই হাটের অবস্থান। বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ ব্যবস্থাপনায় এই সীমান্ত হাট গত ২৪ মে উদ্বোধন করা হয়। সুনামগঞ্জ শহর থেকে এই হাটের দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার। এটি সুনামগঞ্জে তৃতীয় সীমান্ত হাট। সুনামগঞ্জে এর আগে ২০১২ সালের ২৪ এপ্রিল সদর উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী ডলুরা এলাকায় প্রথম সীমান্ত হাট চালু হয়। দ্বিতীয় সীমান্ত হাট চালু হয় জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার বোগলাবাজার ইউনিয়নের বাগানবাড়ি ও ভারতের রিংকু এলাকার মধ্যবর্তী স্থানে গত বছরের ১২ মে।

প্রসাধনসামগ্রীর সঙ্গে নানা জাতের মসলা বিক্রি করি। তবে প্রসাধনসামগ্রীই বেশি বিক্রি হয়। হাটে এক দিনে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করতে পারি
খান সিং, সীমান্তহাটের ভারতীয় ব্যবসায়ী

সরেজমিন নতুন সীমান্ত হাটে ঘুরে দেখা গেছে, যে স্থানে হাট, তার আশপাশটা অনেক সুন্দর। গাছগাছালিতে ভরা। হাটের উত্তরে ভারতের উঁচু মেঘালয় পাহাড়, পশ্চিমে জাদুকাটা নদী, নয়নাভিরাম বারিকের টিলা, পূর্বে শাহ আরেফিন (র.)-এর আস্তানা। হাটের বেচাকেনায় মূলত স্থানীয় লোকজনের অগ্রাধিকার থাকলেও দর্শনার্থী হিসেবে জেলা শহর থেকে যান অনেকে। তাঁরা হাটে কেনাকাটাও করেন। হাটে খুচরা কেনাকাটা চলে। হাট বসে প্রতি বুধবার। হাটের সময় সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা।

হাটের জায়গাটি কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া। দুই দিকে দুটি ফটক আছে। একটিতে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি, অন্যটিতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের পাহারা আছে। টিকিট ছাড়া ক্রেতা-বিক্রেতা কেউই ঢুকতে পারেন না। বাংলাদেশ অংশে টিকিট বিক্রি করছিলেন দুই ব্যক্তি। তাঁরা হাট পরিচালনা কমিটির নির্দেশনায় ২৪ জন বিক্রেতার কাছ থেকে ১০০ টাকা; সাধারণ ক্রেতা, যাঁদের বাড়ি হাটের ৩ কিলোমিটারের মধ্যে, তাঁদের কাছ থেকে ৫০ টাকা এবং দর্শনার্থীদের কাছ থেকে টিকিটপ্রতি ২০০ টাকা করে নিচ্ছিলেন। এই টাকা হাটের উন্নয়নে ব্যয় হবে বলে জানান তাঁরা। বুধবার সাধারণ ক্রেতাদের ৩০০ জনকে টিকিট দেওয়ার কথা থাকলেও মানুষের উপস্থিতি বেশ হওয়ায় টিকিট দিতে হয়েছে ৫০০ জনকে।

ক্রেতাদের ৩০০ জনকে টিকিট দেওয়ার কথা থাকলেও মানুষের উপস্থিতি বেশ হওয়ায় গত বুধবার টিকিট দিতে হয়েছে ৫০০ জনকে
ছবি: প্রথম আলো

হাট এলাকার ভেতরে চারপাশে টিনের ছাউনি দিয়ে দোকানের স্থান নির্ধারণ করে দেওয়া। এসব দোকানের কোনো বেড়া নেই, চারপাশ খোলা। হাটে দুই দেশের ৪৮টি দোকান আছে। দুই দেশের দোকানিরা যাঁর যাঁর দোকানে বাহারি পণ্যের পসরা সাজিয়ে রেখেছেন। এসব পণ্যের মধ্যে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষিপণ্য, সবজি, প্লাস্টিকের সামগ্রী, কাঠের আসবাব, হাঁড়িপাতিল, পান-সুপারি, বিস্কুট, কোমল পানীয়, ফল, নানা জাতের মসলা, শিশুখাদ্য, খেলনা, কাপড়চোপড়, জুতা, ছাতা ও প্রসাধনসামগ্রী বিক্রি করতে দেখা গেছে। প্রতিটি দোকানের সামনেই মানুষের ভিড়। ভারতীয় দোকানগুলো পরিচালনায় পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও আছেন। নির্ধারিত দোকানের বাইরে হাটের ভেতরেই খোলা জায়গায় হাঁস, মুরগি ও মাছ বিক্রি করতে দেখা গেল কয়েকজনকে।

সীমান্ত হাটে ভারতের লালঘাট এলাকার বাসিন্দা খান সিং (২৯) নামের এক দোকানি বলেন, তিনি ও তাঁর বোন এস মারাক (২৫) মিলে প্রতি বুধবার হাটে পণ্য নিয়ে আসেন। তাঁরা প্রসাধনসামগ্রীর সঙ্গে নানা জাতের মসলা বিক্রি করেন। তবে প্রসাধনসামগ্রীই বেশি বিক্রি হয়। হাটে এক দিনে তাদের ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হয়।

বিভালিং সাংমার (৩০) দোকানের সামনে ক্রেতাদের ভিড় বেশি দেখা গেল। বৃষ্টিতে দোকানের সামনে কাঁদা জমে আছে। তাতেই দাঁড়িয়ে আছেন ক্রেতারা। তাঁর দোকানে প্রসাধনসামগ্রী, কাপড়, জুতা ও খাবারের জিনিস আছে। সীমান্তের ওপারে গোমাঘাট এলাকায় তাঁর বাড়ি। দোকান পরিচালনার সুবিধার্থে এপারের লাউড়েরগড় গ্রামের যুবক রাহুল আহমদকে সহযোগী হিসেবে রেখেছেন। বিভালিং বলেন, ‘বেচাবিক্রি ভালা অয়। বাংলাদেশি টেকায় এক লাখ টেকার বেশি অয়। বাজার চালুতে দুই দেশের মানুষে আমরার সম্পর্ক আরও ভালা অইছে।’ ওপারের চিকনবাড়ি এলাকার কবিতা হাজং দুটি হাঁস আর কিছু সবজি কিনেছেন। হাট চালু হওয়ায় কী লাভ হলো, তা জানতে চাইল তিনি বলেন, ‘আমাদের সীমান্তের মানুষের সম্পর্ক সব সময়ই ভালো। এখন সপ্তাহে এক দিন দেখা-সাক্ষাৎ হয়। ভালো লাগে।’

বাংলাদেশের শাহিদাবাদ গ্রামের মোবারক হোসেন (৩৫) ও রইস মিয়া (৪০) একটি দোকান চালান এখানে। কথায় কথায় জানান, দোকানপ্রতি সপ্তাহে ১০০ টাকা দিলেই হয়। আর কোনো টাকা লাগে না। তবে এখানে বাংলাদেশের পণ্য বিক্রি কম হয়। বাংলাদেশি ক্রেতা বেশি, ভারতীয় ক্রেতা কম। আবদুল জলিল নামের লাউড়েরগড় গ্রামের এক দোকানি বলেন, সব মিলিয়ে বেচাবিক্রি মন্দ না। দিন দিন বাজার জমছে।

হাটে বাংলাদেশি ক্রেতা বেশি, ভারতীয় ক্রেতা কম বলে জানালেন কয়েকজন ব্যবসায়ী
ছবি: প্রথম আলো

বাজার জমলেও বাজারের যাওয়ার রাস্তাটি কাঁচা। ভেতরে বৃষ্টির পানিতে কাদা জমে আছে। মানুষের চলাফেরায় সমস্যা হচ্ছে বলে জানান কয়েকজন। স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলছিলেন, হাটের রাস্তা ও ভেতরে ক্রেতাদের চলাফেরার সুবিধার জন্য কিছু অংশ পাকা করা কিংবা ইট বিছিয়ে দেওয়া জরুরি। হাটের উন্নয়ন হলে দুই দেশের মানুষই উপকৃত হবেন।

স্থানীয় বাসিন্দা আলম সাব্বির বলছিলেন, সীমান্ত হাট চালু হওয়ায় স্থানীয় লোকজন খুশি। অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। সীমান্তের মানুষের মধ্যে হৃদ্যতা বেড়েছে।

তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুপ্রভাত চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সীমান্ত হাট চালু হওয়ায় দুই দেশের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। পাশাপাশি দুই দেশের মানুষের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হচ্ছে। হাটের উন্নয়নে আমাদের পরিকল্পনা আছে। রাস্তাটি পাকা করার জন্য উপজেলা পরিষদ থেকে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ভেতরেও কিছু কাজ হবে।’