‘আমাকেই–বা কয় দিন মনে রাখবে মানুষ...’

পারিবারিক এই ছবিটির সব মানুষই আছে। কেবল নেই রাহুল সাহা (সর্ব ডানে)ছবি: সংগৃহীত

৪ মে একটি পারিবারিক ছবি নিজের ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন রাহুল। তাতে লিখেছিলেন, ‘শুভ জন্মদিন কাকা আমার’। বড় ভাইয়ের ছেলের জন্মদিনে তোলা ছবিটি। ছবিতে মা-বাবা, বড় ভাই, বড় বোনসহ সবাই ছিলেন। এক সপ্তাহ না যেতেই নিজেই ছবি হয়ে গেলেন রাহুল সাহা।

গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে নগরের নিমতলা ফায়ার স্টেশনের সামনে কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী এই যুবক ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হন অপর মোটরসাইকেল আরোহী তাঁর বন্ধু অর্পিতা সরকার। তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আজ শনিবার ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। তাঁরা দুজন পতেঙ্গার দিক থেকে ফিরছিলেন।

রাহুল সাহা সীতাকুণ্ডের বার আউলিয়া এলাকার সন্তোষ সাহার ছোট ছেলে। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে রাহুল সবার ছোট। মা–বাবা থাকতেন বড় ভাই প্রবাল সাহার সঙ্গে খুলশী এলাকায়। রাহুল নগরের রাজাপুকুর লেনে সেজ বোন সীমা রানী সাহার সঙ্গে থাকতেন। তিনি ইন্টারনেট প্রোভাইডারের ব্যবসা করতেন। নেশা ছিল মোটরসাইকেল। সেটাই কাল হলো বলে মনে করছেন স্বজনেরা।

রাহুলের বোনের বর কানন চৌধুরী বলেন, ‘আট বছর ধরে আমার বাসায় থাকত সে। চার ভাইবোনের মধ্যে সবার আদরের ছিল। মোটরসাইকেলই তার কাল হলো। অনেক নিষেধ করেছি বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালাতে। কিন্তু শোনেনি।’

নতুন মডেলের সুজুকি মোটরসাইকেলটি কিছুদিন আগে তিনি কিনেছিলেন। এর আগে তাঁর টিভিএস ব্র্যান্ডের আরেকটি মোটরসাইকেল ছিল। ওটা বিক্রি করে মাসখানেক আগে নতুন মোটরসাইকেলটি কেনেন। পাঁচ মাস আগেও তিনি একবার দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন। ব্যথা পেয়ে প্রায় ১৫ দিন মোটরসাইকেল চালাননি।

কানন চৌধুরী বলেন, সেবার হাত–পায়ে ব্যথা পেয়েছিল। এরপর কয়েক দিন মোটরসাইকেল ধরেনি। পরে নতুন বাইক কিনে আবার চালানো শুরু করে। আর সব শেষ হয়ে গেল।

প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করা রাহুল নগরের চেরাগী পাহাড়ে আড্ডার পরিচিত মুখ ছিলেন। প্রায় প্রতিদিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন রাহুল সাহা। তাঁর মৃত্যুর খবরে চেরাগী চত্বরেও বিষাদ ছুঁয়ে গেছে।

রাহুলের বন্ধু রনি দেবনাথ বলেন, ‘আমার দোকান জামালখানে। মোটরসাইকেল নিয়ে আমার এখানে আসত সে। বন্ধুবান্ধবেরা ঘুরেফিরে জামালখান চেরাগী পাহাড় এলাকায় থাকতাম। কাল যখন অপর এক বন্ধু রাহুলের মৃত্যুর সংবাদটি মুঠোফোনে জানাল, তখন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে।’

বিশ্বাস করতে পারছেন না কেউ। বাঁধভাঙা কান্নার গগনবিদারী রব উঠেছে বার আউলিয়ার সন্তোষ সাহার বাড়িতে। আজ সকাল ১০টায় রাহুলের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। মা রূপসী সাহা রাহুল রাহুল বলে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। ‘ভাই ভাই’ বলে দুই বোনের গগনবিদারী আর্তনাদে ভারী হয়ে আসছিল পরিবেশ।

বাইক চালাতে ভীষণ পছন্দ করতেন তরুণ রাহুল সাহা। আর সেটাই কাল হলো তাঁর। গতকাল শুক্রবার সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় এই তরুণের
সংগৃহীত

বোন সীমা সাহা ও রাহুল ছিল পিঠাপিঠি। সীমা দেড় বছরের বড়। দুজনের মধ্যে খুনসুটি লেগেই থাকত। বিয়ের পর নিজের কাছেই রেখেছিলেন ছোট ভাইকে। ভাইটির বিয়ের তোড়জোড়ও শুরু করেছিলেন। অসম্ভব টান ছিল পরস্পরের।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে একবার অসুস্থ হয়ে এভারকেয়ার হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি ছিলেন সীমা। তখন সার্বক্ষণিক বাইরে বসে থাকতেন রাহুল। ২২ সেপ্টেম্বর একটি স্ট্যাটাস দেন ফেসবুকে। সেখানে রাহুল লেখেন, ‘আজ আটটা দিন এই আইসিইউর সামনে বসে আছি। এ দরজাটা খুললে সবার মনে অন্য রকম একটা ভয় কাজ করে। এটা শুধু যারা এখানে থাকে, তারা বোঝে।’

সেই যাত্রায় সীমা বেঁচে ফিরেছেন। তাই এখন ভাই হারানোর কষ্টটা বোঝাতে পারছেন না কাউকে। ভাইয়ের শোকে চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে। কাঁদছে বন্ধুবান্ধব পাড়া-প্রতিবেশীও। সবার আফসোস—‘তিরিশের কোটা না পেরোতেই শেষ হয়ে গেল তরতাজা একটা প্রাণ।’

গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর রাহুল আরেকটা স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘প্রয়োজন ফুরালে মানুষ যেখানে তার “সৃষ্টিকর্তা” ভুলে যায়, সেখানে আপনাকে, আমাকেই–বা কয় দিন মনে রাখবে...!’

রাহুলের এ কথায় হয়তো কিছুটা সত্যতা আছে। কিন্তু মা–বাবা ও ভাইবোনেরা কি ভুলতে পারবেন তাঁদের পারিবারিক অ্যালবাম থেকে ছবি হয়ে যাওয়া প্রাণের রাহুলকে!