প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পাওয়া কুতুবদিয়ার লায়লা বেগম এখন বেড়িবাঁধ চান

বালুচরে দাঁড়িয়ে লায়লা বেগ ও তাঁর স্বামী দেখাচ্ছেন সাগরের গ্রাসে বিলীন হওয়া তাদের পুরোনো বসতবাড়ি ও ফসলি জমি। কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার কৈয়ারবিলে
ছবি-প্রথম আলো

২১৫ দশমিক ৮০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়া। এই দ্বীপের উত্তর-পশ্চিমে কৈয়ারবিল ইউনিয়ন। ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের হাজি মফজল মিয়া গ্রামের বাসিন্দা লায়লা বেগম (৬৬) গত ৩২ বছরে সমুদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে আছেন। বারবার সাগরে ঘর হারানো এই নারী সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়েছেন। তবে বেড়িবাঁধ না থাকায় উত্তাল সাগর আবারও তাঁর ঘর কেড়ে নিতে পারে, এমন আশঙ্কা তাঁর। এ কারণে এখন তিনি অরক্ষিত উপকূলে বেড়িবাঁধ চান।

গত সপ্তাহে লায়লা বেগমের বাড়িতে গেলে তিনি এমন আশঙ্কার কথা বলেন। স্বামী আবদুল ওয়াহেদকে (৮৫) নিয়ে সমুদ্রের বালুচরে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে দেখান তিনি। যে জায়গায় এখন সমুদ্র, সেই জায়গায় ঘর ছিল তাঁদের।

লায়লা বেগম বলেন, একসময় দুই কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের মধ্যেই ছিল তাঁদের ঘরবসতি। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে সবকিছু হারিয়েছেন তাঁরা। এখন যেখানে ঘর করে থাকেন, সেখানেও জলোচ্ছ্বাসের থাবা পড়ে। নারকেলসহ অন্যান্য গাছ উপড়ে পড়ছে।

ঘরটিও যদি সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায়, তাহলে মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে না। লায়লা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাকা ঘর নির্মাণ করে দিয়েছেন। এ জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু বেড়িবাঁধ না থাকায় যেকোনো মুহূর্তে উপহারের ঘরটিও বিলীন হতে পারে। আমরা বেড়িবাঁধ চাই।’

২০২২ সালের ২৬ জুলাই প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে ‘সমুদ্রের সঙ্গে ৩১ বছরের সংগ্রাম লায়লার, জোটেনি মাথা গোঁজার নিরাপদ ঠাঁই’ শিরোনামে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন লায়লাকে একটি সেমিপাকা ঘর নির্মাণ করে দেয়। এখন পর্যন্ত লায়লা ও তাঁর অসুস্থ স্বামী সেই ঘরে থাকছেন।

লায়লা বলেন, প্রথম আলোয় সংবাদ প্রকাশের সুবাদে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি জানতে পেরে তাঁকে ঘর দিয়েছেন। এ জন্য কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কিন্তু বেড়িবাঁধ না থাকায় তাঁদের সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকতে হয়।

সমুদ্রের সঙ্গে লায়লার ৩২ বছরের সংগ্রাম। এই সমুদ্র তাঁর সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। অভাব-অনটন যেন লায়লার নিত্যসঙ্গী। অসুস্থতার কারণে স্বামীও কাজ করতে পারেন না। লায়লা ও আবদুল ওয়াহেদ—দুজনই সরকারের বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন। তবে এ টাকায় তাঁদের সংসার চলে না।

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে কুতুবদিয়া উপজেলায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছিল। ওই সময় লায়লা তাঁর চার মেয়েকে হারিয়েছেন। তাদের বয়স ছিল ২ থেকে ৮ বছরের মধ্যে। ওই বছর জলোচ্ছ্বাসের সময় লায়লা, তাঁর স্বামী ও ১১ বছরের ছেলে ফরিদুল আলম ভেসে যায়। পরে উঁচু গাছে উঠে প্রাণে বাঁচে বাবা-ছেলে। মুমূর্ষু অবস্থায় স্থানীয় এক ব্যক্তি লায়লাকে উদ্ধার করেছিলেন। ৩২ বছর আগের সেই কথা মনে করলে লায়লা এখনো আঁতকে ওঠেন।

লায়লা বলেন, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে তাঁর পাঁচ কানি (দুই একর) জমি ও বসতঘর ভেসে গিয়েছিল। এরপর গত ৩০ বছরে তাঁর বসতঘর কতবার ভেঙেছে, তার হিসাব নেই তাঁর কাছে।

লায়লার স্বামী আবদুল ওয়াহেদ বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের আগে নিজের জমিতে ধান ও সবজি চাষ করে সংসার ভালোভাবে চলত। পরে সব ভেসে গেল। এরপর দিনমজুরের কাজ করে কোনোরকমে দিন পার করতেন। এখন শরীরে শক্তি নেই। ঘরে শুয়েবসেই সময় পার করেন তিনি।

লায়লার একমাত্র ছেলে ফরিদুল এখন আলাদা থাকেন। তাঁর ঘরে স্ত্রী ও চার সন্তান। দিনমজুরের কাজ করে তাঁর সংসারও ঠিকমতো চলে না।

৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মীর কাশেম ঘটনাস্থলে প্রথম আলোকে বলেন, ওই এলাকায় বেড়িবাঁধের বাইরে ৪৫০টি দরিদ্র পরিবারের বসবাস। প্রথম আলোয় লেখালেখি হলে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের একটি ঘর পান লায়লা বেগম। কিন্তু অন্যদের ভাগ্যে জুটছে না কোনো ঘর। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সংকেত পড়লে ঝুপড়ি ঘরের মানুষগুলোকে চরম আতঙ্কে থাকতে হয়। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য গ্রামে ঘূর্ণিঝড়কেন্দ্রও নেই।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দীপংকর তঞ্চঙ্গা বলেন, দ্বীপে খাসজমির সংকট রয়েছে। তারপরও গৃহহীন অতিদরিদ্র পরিবারের লোকজনের মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর উপহারের পাকা ঘর পেয়েছে গৃহহীন ৪১টি পরিবার। এর মধ্যে ১৭টি কৈয়ারবিলের নজর আলী মাতবরপাড়া এবং ২৪টি বড়ঘোপ ইউনিয়নের মুরালিয়া গ্রামে। এর আগে আরও ১১৮টি গৃহহীন পরিবারকে উপহারের ঘর তুলে দেওয়া হয়।