শতবর্ষী গর্জন বনের ভেতরে পাশাপাশি দুটি বেষ্টনী। একটির ভেতরে আছে জুঁই আর জয়। বয়স ১২ বছর। এই বেষ্টনীতে ১১ বছর ধরে একসঙ্গে আছে এই দম্পতি। এদের সংসারে জন্ম নিয়েছে নয়ন। নয়নের বয়স এখন ৭। নয়নের সঙ্গী হিসেবে বেষ্টনীতে আনা হয়েছে দুই বছরের বড় আঁখিকে। আঁখির বয়স এখন ৯। পৃথক দুই বেষ্টনীতে খেলাধুলা আর হুংকার ছেড়েই সময় পার হচ্ছে জয়-জুঁই ও নয়ন-আঁখির।
এতক্ষণ ধরে যাদের কথা হচ্ছে, তারা মানুষ নয়। তারা বনের হিংস্র প্রাণী বাঘ। বাঘগুলো রাখা আছে কক্সবাজার শহর থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে চকরিয়ার ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে। ছোটবেলা থেকেই বাঘগুলো বড় হয়েছে এখানে।
বাঘগুলোর চেনা মানুষ হলো নুরুজ্জামান। বেষ্টনীর পাশে দাঁড়িয়ে নুরুজ্জামান যে বাঘের নাম ধরে ডাক দেন, মুহূর্তেই সে দৌড়ে হাজির। ডাক শুনে জয়-জুঁই কিংবা নয়ন-আঁখি ছুটে এলে তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেন নুরুজ্জামান। খাবার তুলে দেন মুখে। আর এসব অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেন দর্শনার্থীরা।
প্রতিদিন সাফারি পার্ক ভ্রমণে আসা দর্শনার্থীদের মূল আকর্ষণ থাকে বাঘের বেষ্টনী। বাঘের দৌড়ঝাঁপ দেখে সবাই আনন্দে মাতেন। ২০১১ সালে রাজধানীর শ্যামলী এলাকা থেকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্যরা ২১ দিন বয়সী দুটি বাঘশাবক উদ্ধার করেছিলেন। এরপর শাবক দুটিকে পাঠানো হয় এই সাফারি পার্কে। নাম রাখা হয় জয় আর জুঁই। তখন থেকে এই সাফারি পার্কে বাঘ অন্তর্ভুক্ত হয়।
সম্প্রতি সাফারি পার্কে গিয়ে দেখা যায়, জয় ও জুঁই একটি বেষ্টনীতে ঘাসের ওপর শুয়ে আছে। এ সময় পার্কের বন্য প্রাণী সংরক্ষক নুরুজ্জামান জোরে ডাক দিয়ে বললেন, ‘জয় এসো, জয়...!’ শোনার পর দৌড়ে এল একটি পুরুষ বাঘ। কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে জয় দাঁড়িয়ে আছে। খাঁচার ফাঁক গলে হাত ঢুকিয়ে নুরুজ্জামান জয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছেন। হুংকার ছেড়ে জয় নিজের মুখ হাঁ করে থাকে। নুরুজ্জামান হাত দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেন।
নুরুজ্জামানের বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার রসুলপুরের বরবড়া গ্রামে। ১২ বছর ধরে তিনি পালাক্রমে সাফারি পার্কে বাঘ-সিংহ ও ভালুকের দেখাশোনা করছেন। তৃতীয় দফায় গত এক বছরে বাঘ বেষ্টনীতে চারটি বাঘের দেখাশোনা করছেন। কিছুক্ষণ পর নুরুজ্জামান ডাক দিলেন আরেকটি বাঘকে। তখন বাঘটি পাকা ভবনের নিচের একটি কক্ষে শুয়ে ছিল। ডাক শুনে বাঘটি দরজার এসে বাইরে উঁকি দিল। দূরে নুরুজ্জামানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছুটে এল কাছে। এই বাঘের নাম নয়ন।
নুরুজ্জামান বলেন, বাঘশাবকগুলো ছোটবেলা থেকেই তাঁর তত্ত্বাবধানে আছে। এখন বাঘগুলো অনেক বড় হয়েছে। সারা দিন ওরা খুনসুটি করে। মানুষ দেখলে মাঝেমধ্যে বিকট শব্দে হুংকার ছাড়ে। সকাল ছয়টা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত বাঘগুলোকে খোলা মাঠের বেষ্টনীতে রাখা হয়। দর্শনার্থীরা দূর থেকে বাঘের দৌড়ঝাঁপ দেখে মুগ্ধ হন। সন্ধ্যার পর বাঘগুলোকে বেষ্টনীর পাশের একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ওই কক্ষের দরজায় তালা লাগানো হয়।
এ পর্যন্ত বাঘের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন কি না, জানতে চাইলে নুরুজ্জামান বলেন, প্রথম দিকে কয়েক বছর বাঘশাবক কোলে নিয়ে তিনি আদরযত্ন, লালন-পালন করেছেন। খেলতেন শাবকদের সঙ্গে। দাঁত থাকলেও বাঘশাবক কখনোই কামড় দিত না। তবে এখন ওরা বড় হয়েছে। নুরুজ্জামানের ভাষায়, ‘কামড় দিতেও পারে, না-ও দিতে পারে। ওদের বিশ্বাস নাই।’
চার বছর আগের ভয়ংকর স্মৃতিচারণা করে নুরুজ্জামান বলেন, ২০১৬ সালের মার্চ মাসের কথা। একদিন বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে খাবার দেওয়ার জন্য বেষ্টনীতে ঢুকেছিলেন তিনি। তখন বাঘগুলো কক্ষের ভেতরে। খাবার দিয়ে আসার সময় তিনি খেয়াল করেন কক্ষের দরজা খোলা। তখন গা হিম হয়ে এসেছিল নুরুজ্জামানের। ইচ্ছা করলে সেদিন বাঘগুলো তাঁকে হজম করে ফেলতে পারত। তবে সে রকম কিছুই হয়নি।
২০০১ সালের ১৯ জানুয়ারি ২ হাজার ২৫০ একর বনাঞ্চলে গড়ে তোলা হয় দেশের প্রথম এই সাফারি পার্ক। এর আগে ১৯৮০ সালে এটি ছিল হরিণ প্রজননকেন্দ্র। বর্তমানে পার্কের ভেতরে আবদ্ধ অবস্থায় আছে সিংহ, বাঘ, জেব্রা, জলহস্তী, ময়ূর, অজগর, কুমির, হাতি, ভালুক, হরিণ, শকুন, কচ্ছপ, রাজধনেশ, কাকধনেশ, ইগল, সাদা বক, রঙিলা বক, সারস, মথুরা, নিশিবক, কানিবক, বনগরুসহ ৫২ প্রজাতির ৩৪১ প্রাণী।
উন্মুক্তভাবে আছে ১২৩ প্রজাতির ১ হাজার ৬৫ প্রাণী। এর মধ্যে গুইসাপ, শজারু, বাগডাশ, মার্বেল ক্যাট, গোল্ডেন ক্যাট, ফিশিং ক্যাট, খেঁকশিয়াল, বনরুই উল্লেখযোগ্য। হেঁটে পার্ক ভ্রমণের সময় অসংখ্য বানর, শিয়াল, খরগোশ, হরিণসহ বন্য প্রাণীর দৌড়ঝাঁপ দেখা যায়।
সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাজহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার দর্শনার্থী এই সাফারি পার্কে বেড়াতে আসেন। করোনা মহামারির দুই বছর বাঘগুলো দর্শনার্থীর দেখা পায়নি। তখন ওরা প্রায় সময় খাঁচায় বন্দী থাকত। তবে এখন নিয়মিত দর্শনার্থীর ভিড়ে বাঘগুলো চাঙা আছে। মাঝেমধ্যে হুংকার ছেড়ে জানান দেয়, সাফারি পার্কেও বাঘের রাজত্ব চলে। প্রথম দিকে বাঘশাবকদের দুধ খাওয়ানো হতো। এখন সপ্তাহের ছয় দিন একবেলায় ছয় কেজি করে গরুর মাংস খাওয়ানো হচ্ছে।