চা-বাগানমালিক নেতার সাক্ষাৎকার

পঞ্চগড়ে তৃতীয় নিলামকেন্দ্রের কারণে উত্তরাঞ্চলে টাকার লেনদেন বাড়বে

পঞ্চগড়ে দেশের তৃতীয় চা নিলামকেন্দ্রের (অনলাইনভিত্তিক) যাত্রা শুরু হয়েছে ২ সেপ্টেম্বর। এই নিলামকেন্দ্র কীভাবে কাজ করবে, এর ফলে চা-শিল্পে জড়িত ব্যক্তিরা কীভাবে উপকৃত হবেন—এসব বিষয় নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে স্মল টি গার্ডেন ওনার্স অ্যান্ড টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আমিরুল হকের সঙ্গে।

আমিরুল হক
প্রশ্ন:

পঞ্চগড়ে চায়ের নিলামকেন্দ্র স্থাপন কেন জরুরি ছিল?

আমিরুল হক: পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলের সমতলের চা দিন দিন অনন্য উচ্চতায় উঠছে। বর্তমানে জাতীয় চা উৎপাদনের প্রায় ১৯ শতাংশ সমতল থেকেই যুক্ত হচ্ছে। আমরা আশা করছি, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের মোট চা উৎপাদনের ৫০ শতাংশ সমতল থেকেই যুক্ত হবে। মূলত, এ জন্যই আমদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল পঞ্চগড়ে একটি চা নিলামকেন্দ্র স্থাপনের। আমাদের সেই দাবি বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালের ৪ নভেম্বর পঞ্চগড়ে দেশের তৃতীয় চা নিলামকেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

প্রশ্ন:

এই নিলামকেন্দ্র স্থাপনের ফলে সমতলের চা–চাষিরা কীভাবে উপকৃত হবেন বলে আপনি মনে করেন?

আমিরুল হক: নিলামকেন্দ্রের মাধ্যমে চা–চাষিদের সরাসরি উপকৃত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এখানে কারখানার উৎপাদন খরচ কমলে তাঁদের লাভের অংশ বাড়বে। যদি কারখানার মালিকেরা ন্যায্যমূল্যের পাওনা বুঝিয়ে দেন, তাহলে চাষিরা কিছুটা উপকৃত হবেন। যেমন এখানে কাঁচা চা–পাতার মূল্য প্রতি কেজি ১৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু কারাখানার মালিকেরা সেটা মানেননি। যদি তাঁরা এই দাম দিতেন, তাহলে চাষিরা নিগৃহীত হতেন না। এখন থেকে কারাখানাগুলোর চা পরিবহনের খরচ কমে যাবে। সে ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতি কেজিতে কমপক্ষে দুই টাকা উৎপাদন খরচ কমবে। এখন সেই দুই টাকা থেকে এক টাকা যদি তাঁরা চাষিদের না দেন, তাহলে তো চাষিরা উপকৃত হবেন না। এ ছাড়া কারাখানাগুলো অভিযোগ করে, পাতা খারাপ আর আমরা চাষিরা অভিযোগ করি, সময়মতো চা–পাতা তোলার সিরিয়াল না দেওয়ায় পাতা বড় হয়ে যায়। এ সমস্যার সমাধান না হলে চাষিদের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তির ঘাটতি থেকেই যাবে। তবে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন চা কারাখানার মালিক ও ব্যবসায়ীরা। আর কারখানার মালিকদের সদিচ্ছা ছাড়া চাষিদের সরাসরি উপকৃত হওয়ার সুযোগ নেই।

প্রশ্ন:

অনলাইনভিত্তিক নিলামকেন্দ্রটি কী প্রক্রিয়ায় চলবে?

আমিরুল হক: নিলামকেন্দ্রের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ থাকবে স্মল টি গার্ডেন ওনার্স অ্যান্ড টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের হাতে। আর ব্রোকার হাউসগুলো বিডারদের নিয়ে নিলামের আয়োজন করবে। ব্রোকার হাউসগুলোর কাছে আর্থিক দায়িত্ব থাকবে। নিলামে অংশ নিতে হলে ব্রোকার ও বিডারদের টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হতে হবে। নিলামকেন্দ্রের উদ্বোধনের দিন আনুষ্ঠানিকভাবে ২০০ কেজি তৈরি চা বিক্রি হয়েছে। চা বোর্ড একটি সভা করে সেখানে নিলামের শিডিউল তৈরি করবে। সেই শিডিউল অনুযায়ী পরবর্তী নিলাম হবে। আমরা প্রতি মাসে অন্তত দুটি নিলামের প্রস্তাব দিয়েছি। নিয়ম অনুযায়ী নিলামের ১৪ দিন আগে ব্রোকারদের কাছ থেকে বিডাররা চায়ের নমুনা সংগ্রহ করবেন। সেই নমুনা অনুযায়ী তাঁরা বিড করবেন। এরপর বিডাররা ব্রোকার হাউসের কাছে টাকা জমা দেবেন। নিলাম হয়ে যাওয়ার পর ব্রোকার হাউসগুলো সরকারি রাজস্ব, ওয়্যার হাউসের ভাড়া ও নিজের কমিশন কেটে নিয়ে চায়ের মালিককে তাঁদের মূল্য পরিশোধ করবে। তবে অনলাইনে এই নিলাম অনুষ্ঠিত হওয়ায় বিডাররা এখানে না এসেই নিলামে অংশ নিতে পারবেন। নিলামে টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন আর্থিকভাবে লাভবান হবে না। তবে চা বোর্ড যদি তাদের ভ্যাট-ট্যাক্স ঠিকমতো না পায়, সে ক্ষেত্রে তারা অ্যাসোসিয়েশনের কাছে জবাব চাইবে।

প্রশ্ন:

এই নিলামকেন্দ্রে বায়ার-বিডারদের কেমন সাড়া পাওয়া যাবে বলে আপনি মনে করেন?

আমিরুল হক: চায়ের মোট কনজিউমের ৭০ শতাংশই কিন্তু উত্তরবঙ্গে। চট্টগ্রামে চা তৈরি হলেও চট্টগ্রাম ও কুমিল্লার মানুষ কিন্তু চা কম পান করে। পঞ্চগড় থেকে খুলনা পর্যন্ত চায়ের বিক্রি বেশি হয়। সে ক্ষেত্রে আমাদের লোকাল বায়াররা যদি অবৈধ পথে চা না কিনে নিলাম থেকে তৈরি চা কিনে মোড়কজাত করে বিক্রি করেন, তাহলে আমাদের নিলামকেন্দ্র ভালোভাবে চলবে। সে ক্ষেত্রে কারখানার মালিক ও চাষিরা উপকৃত হবেন। অবৈধ পথে যেন চা বিক্রি না হয়, সে জন্য প্রশাসনের নজরদারি বাড়াতে হবে।

প্রশ্ন:

এই নিলামকেন্দ্র এখন অনলাইনভিত্তিক। ভবিষ্যতে এটি সরাসরি (সশরীর উপস্থিতি) চালু করার পরিকল্পনা আছে?

আমিরুল হক: বিষয়টি সময়ের দাবি অনুযায়ী যখন যে অবস্থা দাঁড়াবে, সেভাবেই হয়তো ব্যবস্থা হবে।

প্রশ্ন:

দেশের তৃতীয় চা নিলামকেন্দ্র উত্তরাঞ্চলের উন্নয়নের ক্ষেত্রে কী ধরনের ভূমিকা রাখবে?

আমিরুল হক: এ নিলামকেন্দ্র শুধু চা–শিল্প নয়, পঞ্চগড়, তথা উত্তরাঞ্চলের সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। এলাকার ভ্যানচালক থেকে শুরু করে হোটেল-রেস্তোরাঁ, ব্যাংকিং সেক্টরসহ সবকিছুই উপকৃত হবে। টাকার লেনদেন বাড়বে, বাড়বে মানুষের আনাগোনা।