ছোট্ট তিন নাতি-নাতনি আর পাগল মেয়েকে নিয়ে পথে পথে খালেদা

ষাটোর্ধ্ব খালেদা বেগম তাঁর তিন নাতি-নাতনি নিয়ে সাহায্যের জন্য আসেন মাদারীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

ইশান (৬), শাহবির (৪) ও ইশামনি (৭)। তাদের মা মানসিক ভারসাম্যহীন। বাবা আরেকটি বিয়ে করে ওই সংসার নিয়েই ব্যস্ত। নানি খালেদাই (৬১) একমাত্র ভরসা। তিন নাতি-নাতনি আর অসুস্থ মেয়ের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দিতে রোজ পথে পথে ঘুরে ভিক্ষা করতে হচ্ছে খালেদাকে। দিন শেষে ভিক্ষার থালায় যতটুকু জোটে, তা দিয়েই চলছে তাঁদের কষ্টের জীবন।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে কিছু সহযোগিতা পাওয়ার আশায় আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত খালেদা মাদারীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রধান ফটকের সামনে অপেক্ষা করেন। নাতি ইশান শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় হুইল চেয়ার নিয়ে কার্যালয়ের সিড়ি ভেঙে আর ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি খালেদা বেগম। সিঁড়ির গোড়ায় অভ্যর্থনাকেন্দ্রের পাশে তিন নাতি–নাতনি আর ভারসাম্যহীন মেয়ে নারগীস বেগমকে নিয়ে বসে পড়েন তিনি। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আসা সেবাপ্রত্যাশী ও সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে খালেদা হাত পাতেন নাতি-নাতনিদের জন্য।

অসহায় খালেদা বেগম জানান, তাঁর তিন মেয়ে এক ছেলে। স্বামী আমিনুর ফকির অসুস্থ বলে কোনো কাজকর্ম করতে পারেন না। একমাত্র ছেলে তাঁর সঙ্গে থাকেন না। মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়ে নারগীস বেগম আর তিন নাতি-নাতনিকে নিয়ে খালেদা থাকেন মাদারীপুর সদর উপজেলার মস্তফাপুর এলাকায়। এ এলাকার সালাম খানের বাগানের মধ্যে থাকা একটি ঝুপড়িঘরে বসবাস করেন তাঁরা।

খালেদা বেগম তাঁর নাতি-নাতনিদের সব সময় ছায়ার মতো পাশে থাকেন। ভিক্ষাবৃত্তি করে তিন বেলা যা পান, তা দিয়েই তিন নাতি-নাতনির জন্য খাবার কেনেন।

খালেদা বেগম আরও জানান, তাঁর তিন মেয়ের মধ্যে মেজ মেয়ে নারগীসের বিয়ে হয় বাগেরহাটে। নারগীসের তিন সন্তান। চার বছর আগে তাঁর ছোট ছেলে শাহবির জন্ম নেওয়ার পরপরই জামাতা নূর মোহম্মদ আরেকটি বিয়ে করেন। এরপরই তিন সন্তান নিয়ে চলে আসেন বাবার বাড়িতে। আস্তে আস্তে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন নারগীস। শিশুসন্তানদের রেখে মাঝেমাঝেই এদিক–সেদিক চলে যান। তাই খালেদা বেগম তাঁর নাতি-নাতনিদের সব সময় ছায়ার মতো পাশে থাকেন। ভিক্ষাবৃত্তি করে তিন বেলা যা পান, তা দিয়েই তিন নাতি-নাতনির জন্য খাবার কেনেন।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আসার কারণ জানতে চাইলে খালেদা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সকাল সকাল স্যারেগো কাছে সাহায্যের জইন্যে আইছি। আমাগো এ অবস্থা দেখে যার মনে চায় কিছু দেয়, যার মনে চায় না দেয় না। সকাল ৯টার কালে আইসা এখন পর্যন্ত (দুপুর ১২টা) ৭০ টাকা হইছে।’

সরকারি প্রকল্পগুলোর সহযোগিতা পান কি না, জানতে চাইলে খালেদা বেগম বলেন, ‘সরকারের কাছে কী আর চাইব? প্রতিবন্ধী বাচ্চাটারে লইয়া রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকি। কেউ তো কিছু সাহায্য করে না। আমাগো চেয়ারম্যান-মেম্বার কেউ সাহায্য করে না। তাগের কেছে গেলে বলে, কী দিব তোমাগের? গরিব কাঙালের লিগা এত এত সাহায্য আহে, কিন্তু আমরা তো পাই না। মাইঝা নাতনিডা হাঁটতে পারে না, ও পঙ্গু। ওরে হুইল চেয়ারডা এক ডাক্তারে দিছে। মাইয়াডার মাথায় বেরেন শর্ট। এই ভালো এই খারাপ। টাহার অভাবে চিকিৎসা করাইতে পারি নাই। এহন ওগের আমি ছাড়া কেউ নাই। ওদের খাবারদাবার সবই আমি খাওয়াই। এভাবেই চাইয়াচুইয়া যা গোছাই, তা দিয়াই খাওয়াই। আইজ সকালে চার খান শুকনা রুটি এক দোকান থেকে চাইয়া আইনা আমরা পাঁচজনে খাইছি।’

এই অসহায় পরিবারটির বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মাদারীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ঝোটন চন্দ প্রথম আলোকে বলেন, অভ্যর্থনাকেন্দ্রের পাশে ও গেটে ঢুকতে অনেকেই সাহায্য চান। সকাল থেকে ষাটোর্ধ্ব এক নারী তাঁর নাতনি আর ভারসাম্যহীন মেয়েকে নিয়ে ভিক্ষা করার বিষয়টি তাঁর চোখে পড়েনি। তবে প্রতিবন্ধী শিশুটির জন্য ভাতা কার্ডসহ পরিবারটির জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন তিনি।