সোনালি ধান ঘরে তুলতে হাওরের বুকে কিষান-কিষানিদের বিশাল কর্মযজ্ঞ
একদিকে এক দল শ্রমিক ধান কাটছেন, অন্যদিকে আরেক দল শ্রমিক ধানের বোঝা মাথায় করে এনে সড়কের পাশে স্তূপ করে রাখছেন। এখান থেকে ট্রাক, লরি, টমটম ও মহিষের গাড়ি দিয়ে ধান খলায় এনে মেশিন দিয়ে মাড়াই করছেন কেউ কেউ। জমির পাশেই ধান সেদ্ধ করছেন অনেক কিষানি। কেউ আবার রোদে ধান শুকানোর কাজে ব্যস্ত। বাজারে বিক্রি করতে বস্তায় ধান ভরছেন অনেকে।
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ ও নিকলী উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত বড় হাওরে গিয়ে এই চিত্র দেখা গেছে। শুধু বড় হাওরই নয়, গত মঙ্গলবার করিমগঞ্জের জয়কা, গুণধর, উরদীঘি, ইটনা উপজেলার এলংজুরী, বড়িবাড়ী, সোহেলা হাওর ঘুরে কিষান-কিষানিদের বিশাল কর্মযজ্ঞ চোখে পড়ে।
কিশোরগঞ্জের হাওরে খেতের পর খেত সোনালি ধানে ভরে গেছে। হাওরের বাতাসে দুলছে ধানের সোনালি শিষ। চলছে খেতভরা সেই ফসল কাটার মহোৎসব। সপ্তাহখানেক আগে থেকে টুকটাক ধান কাটা শুরু হলেও বৈশাখ মাসের প্রথম দিন থেকে পুরোদমে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। কাঁচি হাতে কৃষকেরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ধান কাটায় ব্যস্ত। যেন চারদিকে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের উৎসব চলছে।
সরেজমিন বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অনেক জায়গায় মেশিন দিয়েও ধান কাটা হচ্ছে। হাওরের সর্বত্রই এখন শুধু ধান আর ধান। এসব কাজে এখন নারী-পুরুষ, ছোট-বড়সহ সবাই ব্যস্ত। তা ছাড়া এবার ধানের বাম্পার ফলন পেয়ে কৃষকেরাও খুশি। তবে ধানের যাতে ন্যায্যমূল্য পান, সেই আশা কৃষকদের।
করিমগঞ্জের বড় হাওরে বুলবুল সরদার তাঁর পাঁচ কানি জমিতে চাষ করা ব্রি–২৮ ধান কাটার জন্য ২২ জন শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি বলেন, একজন শ্রমিককে দৈনিক এক হাজার টাকা মজুরি দিয়ে এক হাজার টাকা মণের ধান কাটাতে হচ্ছে। ধানের দাম না বাড়লে কৃষকের মাথায় হাত পড়বে।
খয়রতবন্দ এলাকায় ধান কাটার সময়ে জমির মালিক রমজান মিয়াও একই হতাশার কথা শোনান। তিনি বলেন, ১০ কানি জমির ধান নেত্রকোনা থেকে আসা ২৫ জনের একটি ধান কাটা দলকে চুক্তি দিয়েছেন। ধান লাগানোর খরচের বিষয়টি বাদই দিলেন। কিন্তু ধান কাটা আর ঘরে তুলে বিক্রির পর কৃষকের তেমন কিছুই থাকে না। ১ হাজার ৫০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা ধরে ধান বিক্রি করে কৃষকের আর কী থাকে। সরকারের উচিত কৃষকদের নিয়ে ভাবা। তবে এবার ধানের ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকদের অনেকটা রক্ষা। যদি সময়মতো বৃষ্টি পেত, তাহলে ধানের ফলন আরও ভালো হতো।
নিকলীর মজলিশপুর এলাকার কৃষক সেলিম মিয়ার সঙ্গে কথা হয় নিকলীর বড় হাওরের মজলিশপুর এলাকায়। এ সময় তিনি বলেন, ধান কাটার মেশিন খরচসহ অন্যান্য খরচে মণপ্রতি ধান উৎপাদনে তাঁর খরচ পড়ছে ৮০০ থেকে সাড়ে ৮০০ টাকা। অন্তত ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা মণ দরে যদি তিনি ধান বিক্রি করতে পারতেন তাহলে প্রকৃত সুফল পেতেন।
এ সময় পাশে থাকা সুরুজ মিয়া নামের আরেক কৃষক বলেন, ধান ও শ্রমিকের দাম যা-ই হোক, এবার তিনি ১০ কানি জমিতে ধান করেছেন। যে ফসল হয়েছে, অতীতে তেমনটি হয়নি। এবার ধানের বাম্পার ফলনে তিনি খুশি। ভালোয় ভালোয় যাতে আবহাওয়া অনুকূলে থাকতেই তিনি গোলায় ধান তুলতে পারেন, সেই আশা করেন।
নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুর থেকে সিরাজুল ইসলাম ২১ জনের একটি দল নিয়ে সপ্তাহখানেক আগে কিশোরগঞ্জের হাওরে এসেছেন। দৈনিক এক হাজার টাকা মজুরিতে তাঁরা ধান কাটছেন। সিরাজুল বলেন, তাঁরা আরও ১৫ দিন থাকবেন। তবে ধান কাটার মেশিনের কারণে আগের চেয়ে তাঁদের কদর অনেকটা কমে গেছে। না হলে এ সময়ে তাঁরা হাওরে বেশি সময় থেকে আরও বেশি আয়রোজগার করতে পারতেন।
করিমগঞ্জের বড় হাওরে জমির ব্রি-২৮ জাতের ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন সেলিম ব্যাপারী। দুই একর জমিতে চাষ করা ধান তিনি পয়লা বৈশাখ থেকে কাটা শুরু করেছেন। ধানের ফলন ভালো হয়েছে উল্লেখ করে সেলিম ব্যাপারী বলেন, সেচ খরচ, সার খরচ আর ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকায় শ্রমিকের মজুরি খরচ মিলিয়ে প্রতি মণ ধান উৎপাদনে খরচ পড়ে যায় প্রায় ৯০০ টাকা। অথচ বাজারে এখন প্রথম প্রথম ধান বিক্রি করতে পারছেন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০ টাকায়। তাই কৃষকেরা তাঁদের কষ্টার্জিত ফসলের দামটা যেন সঠিক পান, সেই দাবি করেন তিনি।
কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সাদিকুর রহমান বলেন, এবার জেলার ১৩ উপজেলায় বিভিন্ন জাতের ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১১৫ হেক্টর জমি। আর চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৯১২ টন। হাওরে এখন পুরোদমে বোরো ধান মাড়াই চলছে। পাকা ধান দ্রুত কাটার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যাতে প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগে ক্ষতি না করতে পারে। এবার ধানের বাম্পার ফলন পাবেন কৃষকেরা। শেষ পর্যন্ত যেন কৃষকদের মুখে হাসি থাকে, সেই প্রত্যাশা করেন তিনি।