জাতীয় পার্টিতে মসিউরের ফেরা নিয়ে আলোচনা, রংপুর-১ আসনে মনোনয়ন নিয়ে বিরোধিতা
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমানের (রাঙ্গা) হঠাৎ দলে ফেরা ও সরব হওয়া নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।
রংপুরে জাতীয় পার্টির একটি অংশ মসিউর রহমানকে স্বাগত জানালেও তাঁর নির্বাচনী এলাকা গঙ্গাচড়া উপজেলা জাতীয় পার্টির বড় একটি অংশ বিরোধিতা করছেন। তাঁকে ‘আওয়ামী লীগের’ দোসর উল্লেখ করে রংপুরে প্রতিহতের ডাক দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা–কর্মীরাও।
এ সম্পর্কে মসিউর রহমান প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তিনি জাতীয় পার্টির রাজনীতি করে এত দূরে এসেছেন। তাই জাতীয় পার্টিতে ফিরেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁকে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ বলা অস্বাভাবিক নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
২০০১ সালের পর ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়নে রংপুর-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মসিউর রহমান। এরপর তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী হন। ২০১৮ সালে নির্বাচনে পর জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ হন।
একই সঙ্গে ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ২৬ জুলাই পর্যন্ত জাতীয় পার্টির মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন মসিউর। তবে রওশন এরশাদের পক্ষ নেওয়ার অভিযোগে ওই বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর তাঁকে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ সব পদপদবি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মসিউর রহমান স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। আওয়ামী লীগের একটি অংশ তাঁর পক্ষে ভোট করলেও আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ আসাদুজ্জামান বাবলুর কাছে হেরে যান। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে আর প্রকাশ্যে ছিলেন না মসিউর। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের ঘটনায় হত্যাসহ চারটি মামলা হয়েছে।
২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ২৬ জুলাই পর্যন্ত জাতীয় পার্টির মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন মসিউর। তবে রওশন এরশাদের পক্ষ নেওয়ার অভিযোগে ওই বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর তাঁকে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ সব পদপদবি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
জাতীয় পার্টির সূত্র বলছে, ১৫ ডিসেম্বর রংপুর-১ আসন থেকে জাপার তিনবারের সাবেক সংসদ সদস্য মসিউর রহমান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারীর সঙ্গে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দেখা করেন। ওই দিন ফেসবুকে লাইভে এসে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের কাছে ক্ষমা চেয়ে দলে ফেরার কথা জানান মসিউর।
জাতীয় পাার্টির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভা গতকাল বুধবার সকালে গুলশান-১–এর আইরিশ হলে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারীর সঙ্গে মঞ্চে ছিলেন মসিউর রহমানও।
মসিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে অব্যাহতি দেওয়ার পর থেকে আমি আর অন্য কোনো দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি নাই। মনে করেছিলাম রাজনীতি করব না। আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পরে রাজনীতি করার অবস্থা ছিল না। কিন্তু জাতীয় পার্টি করে এত দূর এগিয়েছি। আগামীতেও দলটির সঙ্গে থাকতে চাই।’
এ সম্পর্কে জাতীয় পাার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রংপুর মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক এস এম ইয়াসির প্রথম আলোকে বলেন, ‘উনি (মসিউর) নতুন করে দলে যোগদান করেছেন। এটা দলের চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত। উনি চেয়ারম্যান সাহেবের পক্ষে থাকলে আমরা তাঁর পক্ষে থাকব।’
মসিউর রহমান ও মকবুল শাহরিয়ারকে এর আগে প্রার্থী করা হলেও তাঁরা স্থানীয় লোক নন। গঙ্গাচড়ার লোকজন স্থানীয় প্রার্থী চান। বাইরের লোকের পক্ষে কাজ করলে মানুষ আমাদের দালাল মনে করে।আবুল কালাম আজাদ, গঙ্গাচড়া উপজেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক
নির্বাচনী আসনে বিরোধিতা
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় ও রংপুর মহানগরের নেতারা মসিউর রহমানকে দলে স্বাগত জানালেও বিরোধিতা করছে গঙ্গাচড়া উপজেলা জাতীয় পার্টির একাংশ।
এই আসনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের ভাতিজা হোসেন মকবুল শাহরিয়ার। তিনি ২০০৮-২০১৪ এই আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। দলের প্রার্থী হওয়া নিয়ে মসিউর ও শাহরিয়ারের দ্বন্দ্ব আগে থেকে।
স্থানীয় জাতীয় পার্টির কয়েকজন নেতার ভাষ্য, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লন্ডনপ্রবাসী মঞ্জুম আলীকে তাঁরা প্রার্থী হিসেবে চান। সে জন্য তাঁরা প্রচার-প্রচারণা ও মতবিনিময় করে আসছেন। হঠাৎ মসিউর রহমান দলে ফেরায় অস্বস্তিতে পড়েছেন তাঁরা।
গঙ্গাচড়া উপজেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মসিউর রহমান ও মকবুল শাহরিয়ারকে এর আগে প্রার্থী করা হলেও তাঁরা স্থানীয় লোক নন। গঙ্গাচড়ার লোকজন স্থানীয় প্রার্থী চান। বাইরের লোকের পক্ষে কাজ করলে মানুষ আমাদের দালাল মনে করে।’
গঙ্গাচড়া উপজেলা জাতীয় পার্টির সদস্যসচিব গোলাম ফারুকও একই রকম বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, তাঁরা মঞ্জুম আলীর পক্ষে ভোট করবেন। তাঁর পক্ষে আজ তাঁরা মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন। দলের চেয়ারম্যানও মঞ্জুম আলীকে আশ্বাস দিয়েছে বলে দাবি তাঁর।
তবে রংপুর-১ আসনে জাপার মনোনয়ন সংগ্রহের কথা জানান মসিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘আজকে (গতকাল) ফরম কিনতেছি গঙ্গাচড়ার জন্য। আমাকে দিবে কি দিবে না, এটা দলের সিদ্ধান্ত।’ তাঁকে নিয়ে বিরোধিতার প্রসঙ্গে মসিউর বলেন, ‘মাঝখানে আমি ছিলাম না। এখন দলের স্বার্থে এসেছি। ওরা যাঁরা বিরোধিতা করছেন, এটা আমি গেলে ঠিক হয়ে যাবে।’
মসিউর রহমান জাতীয় পার্টির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পারপাস সার্ভ (উদ্দেশ্য পূরণ) করতেন। আমরা মনে করি, তিনি দেশে থাকা মানে শেখ হাসিনার একজন মুখপাত্র হিসেবে থাকা।ইমতিয়াজ আহমদ, জাতীয় ছাত্রশক্তির রংপুর মহানগর কমিটির আহ্বায়ক
‘আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনপ্রক্রিয়া সম্পন্ন’
এদিকে মসিউর রহমানের হঠাৎ রাজনীতি তৎপর হওয়া নিয়ে নানা সমালোচনা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা–কর্মীরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তাঁর ছবি ও পোস্ট দিয়ে তাঁকে প্রতিহতেরও ডাক দেওয়া হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর মহানগর কমিটির সাবেক আহ্বায়ক ও জাতীয় ছাত্রশক্তির মহানগর কমিটির আহ্বায়ক ইমতিয়াজ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মসিউর রহমান জাতীয় পার্টির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পারপাস সার্ভ (উদ্দেশ্য পূরণ) করতেন। আমরা মনে করি, তিনি দেশে থাকা মানে শেখ হাসিনার একজন মুখপাত্র হিসেবে থাকা। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের বি টিম জাতীয় পার্টিতে তাঁকে নিয়ে এসে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হলো। এই ব্যর্থতা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের।’
এ বিষয়ে মসিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অ্যালায়েন্সে (জোট) ছিলাম। তাঁকে “আওয়ামী লীগের দোসর” বলা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাদের (আওয়ামী লীগ) মন্ত্রিপরিষদে আমরা মন্ত্রী হয়েছি। প্রধানমন্ত্রী তো আওয়ামী লীগ-ই। এটা দোষের কিছু নয়। আমাদের যদি দোষ থাকে, আমরা মন্ত্রণালয়ে যদি অন্যায় করে থাকি, আমাদের শাস্তি হবে। আমরা বিচারের আওতায় আসব।’