পরিবারের ‘গৃহযুদ্ধ’ যখন ভোটযুদ্ধ

সংসদ নির্বাচনে দুই চাচাতো ভাইয়ের পর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে লড়াইয়ে নেমেছেন ওই পরিবারেরই আপন দুই ভাই।

ঠাকুরগাঁও জেলার মানচিত্র

গত সংসদ নির্বাচনে বালিয়াডাঙ্গী, হরিপুর ও রানীশংকৈল উপজেলার একাংশ নিয়ে গঠিত ঠাকুরগাঁও-২ আসনে লড়েছিলেন মাজহারুল ইসলাম ও আলী আসলাম। তাঁরা দুজন সম্পর্কে চাচাতো ভাই। মাজহারুল ইসলাম সাবেক সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলামের ছেলে। আলী আসলাম দবিরুল ইসলামের ছোট ভাই মোহাম্মদ আলীর ছেলে।

ওই সংসদ নির্বাচনে আলী আসলামকে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন মাজহারুল ইসলাম। সেই রেশ না কাটতেই এবারের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা পরিষদের নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছেন দবিরুল ইসলামের আপন দুই ভাই মোহাম্মদ আলী ও সফিকুল ইসলাম।

সংসদ নির্বাচনে চাচাতো দুই ভাইয়ের যুদ্ধ দেখেছি। সে সময় তাঁদের প্রচারণায় যেসব আক্রমণাত্মক বাক্য বিনিময় হয়েছে, তাতে অনেকে হতাশ হয়েছেন। উপজেলা ভোটে তাঁদের চাচারা মাঠে নেমেছেন। এবার কী হয়, কে জানে?
আবুল হাশেম, দুওসুও গ্রামের বাসিন্দা

গত জানুয়ারি মাসে হয়ে যাওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঠাকুরগাঁও-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন সাতবারের সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলাম, তাঁর ছেলে মাজহারুল ইসলাম, দবিরুল ইসলামের ছোট ভাই ও বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী এবং মোহাম্মদ আলীর ছেলে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আলী আসলাম। কিন্তু এ আসনে মাজহারুল ইসলাম দলের মনোনয়ন পান। এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি তাঁর চাচাতো ভাই আলী আসলাম।

পরে দলের নেতারা চাইলে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রার্থী হতে পারবেন, আওয়ামী লীগ এমন ঘোষণা দিলে আলী আসলাম উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হন। নির্বাচনে চাচাতো দুই ভাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীসহ দবিরুল ইসলামের পরিবারে বিভাজন সৃষ্টি হয়। নির্বাচনে দবিরুল ইসলামের ছোট ভাই সফিকুল ইসলাম মাজহারুল ইসলামের পক্ষে, আরেক ছোট ভাই মোহাম্মদ আলী তাঁর ছেলে আলী আসলামের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেন। তবে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আলী আসলাম হেরে যান। নির্বাচনের পর উভয় পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষেরও ঘটনা ঘটে।

সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন মোহাম্মদ আলী ও সফিকুল ইসলাম। এর পর থেকে তাঁরা পৃথক পৃথক রাজনৈতিক কর্মসূচি চালিয়ে আসছেন। এসব কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আবারও বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ভোট নিয়ে এই লড়াইকে দবিরুল পরিবারে ‘গৃহযুদ্ধ’ বলছেন স্থানীয় মানুষেরা।

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে আগামী ৮ মে এ উপজেলায় ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। গতকাল সোমবার ছিল অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। ১৭ এপ্রিল মনোনয়নপত্র বাছাই হবে। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ২২ এপ্রিল। ২৩ এপ্রিল প্রতীক বরাদ্দ হবে। ৮ মে সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।

এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী দেবেন না। বালিয়াডাঙ্গীতে চেয়ারম্যান পদে মোট চারজন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। মোহাম্মদ আলী ও সফিকুল ইসলাম ছাড়াও এ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা আওয়ামী লীগের আরেক সহসভাপতি আহসান হাবিব ও মোহাম্মদ আলীর ছোট ছেলে আলী আফসার।

দুওসুও গ্রামের বাসিন্দা আবুল হাশেম বলেন, ‘সংসদ নির্বাচনে চাচাতো দুই ভাইয়ের যুদ্ধ দেখেছি। সে সময় তাঁদের প্রচারণায় যেসব আক্রমণাত্মক বাক্য বিনিময় হয়েছে, তাতে অনেকে হতাশ হয়েছেন। উপজেলা ভোটে তাঁদের চাচারা মাঠে নেমেছেন। এবার কী হয়, কে জানে?’

প্রার্থী সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভাই দাঁড়াক আর ফাটাকেষ্ট দাঁড়াক, আমি নির্বাচনের মাঠেই আছি।’ একই পরিবারের ভোটযুদ্ধ বিষয়ে প্রশ্নে তিনি বলেন ‘কে বলল আমরা একই পরিবার। আমাদের সব ভাইরা আলাদা আলাদা। সবারই আলাদা আলাদা পরিবার। আমাদের মধ্যে এখন কথাও হয় না।’

সফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘এটা নতুন কিছু না। অনেক বছর থেকে এখানে আত্মীয়স্বজনের মধ্যেই ভোটের লড়াই হয়ে আসছে। এর আগে বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে আমার ভগ্নিপতি প্রার্থী হয়েছিলেন। গত উপজেলা নির্বাচনে আমার বিরুদ্ধে ভাতিজা প্রার্থী হয়েছিল। আর সংসদ নির্বাচনে বড় ভাই মোহাম্মদ আলী তাঁর ভাতিজার বিরুদ্ধে ছেলেকে দাঁড় করিয়ে দেন। কিন্তু জিততে পারেনি। তিনি যখন দেখলেন ভোটাররা তাঁর ছেলেকে আর খাচ্ছেন না, তখন নিজেই মাঠে নেমে পড়লেন। কার জনপ্রিয়তা কেমন, ভোটেই সেটা প্রমাণ হবে।’

আর সফিকুল ইসলামের বড় ভাই ও আরেক প্রার্থী মোহাম্মদ আলী এ বিষয়ে বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ করে আসছি। দলের জন্য সারাটা জীবন শেষ করে দিয়েছি। দলের কাছে তো কখনো কিছু চাইনি। ভাইয়ের (দবিরুল ইসলাম) আগের জয়ে আমারও বড় হাত রয়েছে। তিনি অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর আমি সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মনোনয়ন পাইনি। তাই এই শেষ বয়সে আমার ইচ্ছা, আবারও একবার উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়া। আমার বিরুদ্ধে ভাই না ভাতিজা দাঁড়াল, সেটা দেখার সুযোগ নেই।’ একই নির্বাচনে তাঁর ছেলে আলী আফসার প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনী কৌশলের কারণে তাকে প্রার্থী করা হয়েছে। তবে মূল প্রার্থী আমি নিজেই।’

দুই ভাইয়ের লড়াই প্রসঙ্গে সাবেক সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য। সবারই রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে। সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হলে দোষের কিছু নেই।’