ঈদের পর আর গরুর মাংস খাওয়া হয়নি শাড়ি বিক্রেতা রাবেয়ার

পাড়া-মহল্লার সড়কে হেঁটে হেঁটে শাড়ি ও থ্রি-পিস বিক্রি করেন রাবেয়া বেগম
ছবি: প্রথম আলো

ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধার কাঁধে কাপড়বোঝাই একটি গাট্টি, হাতে ব্যাগ। কাপড়ের ভারে একদিকে হেলে পড়েছেন ওই বৃদ্ধা। সূর্য তখন মাথার ওপরে। তেজি রোদে পাড়া-মহল্লার সড়কে হেঁটে হেঁটে ওই বৃদ্ধা শাড়ি ও থ্রি-পিস বিক্রি করছেন। আলাপে জানা গেল, তাঁর নাম রাবেয়া বেগম। স্বামী দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। তাই প্রায় দেড় যুগ ধরে সংসারের দায়িত্ব রাবেয়া বেগমের কাঁধে।

রাবেয়া বেগমের বাড়ি বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার সাইনবোর্ড এলাকায়। তবে তিনি পরিবার নিয়ে পিরোজপুর পৌরসভার রাজারহাট মহল্লায় ভাড়া থাকেন। বাড়িতে আছেন স্বামী আমির আলী শেখ (৬৮), মেয়ে রোকসানা বেগম, (৩৮) আর নাতনি সানজিদা আক্তার (১৮)। তবে তাঁদের মধ্যে আমীর আলী অসুস্থ। আর মেয়ে রোকসানা সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে গেছেন।

পরিবারের এমন অবস্থায় রাবেয়া একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য। মূলত নিম্ন আয়ের মানুষই রাবেয়ার ক্রেতা। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ফেরি করে শাড়ি ও থ্রি-পিস বিক্রি করে তাঁর আয় হয় মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে চারজনের খাওয়া, ঘরভাড়া ও ওষুধের খরচ জোগাড় করতে হয়। এর মধ্যে গত কয়েক মাসে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে রাবেয়ার নাভিশ্বাস উঠে গেছে। আবার কিছুদিন পরই রমজান মাস শুরু। সব মিলিয়ে রাবেয়া যেন দিশাহারা হয়ে পড়েছেন।

রাবেয়া বলেন, তাঁর স্বামী আমির আলী একসময় রিকশা চালাতেন। দুই মেয়েকে নিয়ে তাঁদের সংসার ভালোই চলছিল। তবে প্রায় ১৮ বছর আগে আমির আলী শেখ অসুস্থ হয়ে পড়েন। শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছেন অনেক বছর ধরে। এ জন্য তিনি রিকশা চালানো ছেড়ে দেন। বাধ্য হয়ে সংসারের হাল ধরেন রাবেয়া বেগম। শুরু করেন শাড়ি-কাপড়ের ব্যবসা। এভাবে দেড় যুগ পার করে দিয়েছেন। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন। তবে এক মেয়ে রোকসানার স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে। পরে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে রোকসানা চলে আসেন মা-বাবার কাছে। রোকসানাও কয়েক বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে গেছেন। তিনিও কোনো কাজ করতে পারেন না। টাকাপয়সার অভাবে রোকসানার মেয়ে সানজিদার পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে গেছে।

গতকাল সোমবার বেলা দুইটার দিকে পিরোজপুর পৌরসভার রাজারহাট মহল্লার সড়কে কথা হয় রাবেয়া বেগমের সঙ্গে। সকাল থেকে কাপড় নিয়ে ঘুরেছেন। তখন দুপুরের খাবার খেতে ঘরে ফিরছিলেন।

রাবেয়া বেগম বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে বের হই। বাতের ব্যথা। কাঁধে ভারী জিনিস নিয়ে চলতেও কষ্ট হয়। এভাবে সারা দিন খেটে ২০০-৩০০ টাকা আয় হয়। আবার কখনো ৪০০ থেকে ৫০০ টাকাও আয় হয়। সব মিলায় মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা থাকে। এই টাকা থেকেই দেড় হাজার টাকা ঘরভাড়া দিতে হয়। স্বামীর ওষুধ কেনা লাগে। চারজনের সংসারের খরচ আছে।’

সংসার খরচের কথা বলতেই রাবেয়া হতাশ হয়ে পড়েন। রাবেয়া বলেন, ‘আগে জিনিসপত্রের দাম কম ছিল। তখন ভালোমন্দ খেতে পারতাম। কিন্তু এখন ডিম, আলু, শাকসবজি কিনি। মাঝেমধ্যে সস্তায় পাওয়া মাছ কিনে খাওয়া হয়। গত বছর কোরবানিতে প্রতিবেশীদের দেওয়া গরুর মাংস খেয়েছি। এরপর আর গরুর মাংস খাওয়া হয়নি। আগে মুরগি কিনতাম মাঝেমধ্যে। গত দুই মাসে মুরগিও কেনা হয়নি। কদিন পরপর সবকিছুর দাম বাড়ছে। আমার আয় বাড়ছে না। সামনে রোজা আসছে। রোজায় একটু ভালো খেতে হলে তো খরচ আরও বেড়ে যাবে। ঈদে নাতিদের নতুন জামাকাপড় দিতে হবে। এসব ভাবতে গেলে প্রেশার বেড়ে যায়।’

ব্যবসার পরিস্থিতি জানতে চাইলে রাবেয়া বলেন, ‘আমি কম দামের শাড়ি, থ্রি-পিস বিক্রি করি। আমার ক্রেতা সব নিম্ন আয়ের মানুষ। তাই দামি জিনিস বিক্রি করলে কেউ দাম দিতে চায় না। হকারের কাছে সবাই কম দামের জিনিস কিনতে আসে। কাপড়ের দাম বাড়ায় আগের মতোন লাভও হয় না।’

পিরোজপুরের রাজারহাট মহল্লার ডাকবাংলো মোড়ের ব্যবসায়ী আলী আজম বলেন, ‘রাবেয়া বেগমকে কয়েক বছর ধরে চিনি। তিনি খুব পরিশ্রমী নারী। এই বয়সেও ফেরি করে সংসার চালাচ্ছেন।’