অদম্য মেধাবী-২০২৫—৫
অভাব সঙ্গী, স্বপ্ন আকাশছোঁয়া
অভাবের বাধা জয় করে এসএসসিতে এসেছে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। এখন উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন তাদের।
কারও বাবা দিনমজুর, কারও মা-বাবা আলাদা হয়ে গেছেন, কেউ আবার বড় হয়েছে নানির কাছে। নানা অসুবিধা সত্ত্বেও তারা এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ অর্জন করেছে। সবার লক্ষ্য— উচ্চশিক্ষা নিয়ে সমাজ ও মানুষের সেবা করা।
দারিদ্র্য আর প্রতিকূলতার বেড়াজাল ভেঙে নিজেদের স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে চলেছে লালমনিরহাটের ধৃতী রানী কর্মকার, রাজবাড়ীর আরাফ সারজিন, ফরিদপুরের খন্দকার ওয়াহিদা ও যশোরের মোহনা আক্তার। কিন্তু উচ্চশিক্ষার ব্যয় নিয়ে শঙ্কিত পরিবারগুলো।
ঋণের টাকায় ফরম পূরণ ধৃতীর
অভাব-অনটন, ক্ষুধা আর কষ্ট জয় করে লালমনিরহাটের ধৃতী রানী কর্মকার (১৬) এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। কালীগঞ্জের উত্তর ঘনশ্যামের এই অদম্য শিক্ষার্থী পড়েছে তুষভান্ডার নছর উদ্দিন সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে।
বাবা রমানাথ কর্মকার বয়সের ভারে আর আগের মতো কামারের কাজ করতে পারেন না। সামান্য আয়ে সংসার চলে না। মা দীপ্তি রানী দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন। সংসারের টানাটানির মধ্যে ধৃতীকে প্রায়ই না খেয়ে স্কুলে যেতে হয়েছে। নবম-দশম শ্রেণিতে টিউশনি করে কিছুটা খরচ মেটালেও তা ছিল অনিয়মিত।
বাবা রমানাথ কর্মকার বলেন, তাঁর দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। আরেক মেয়ে নার্সিংয়ে ডিপ্লোমা করেছে। সবার ছোট মেয়ে ধৃতী রানী কর্মকারকে ঘিরেই পরিবারের সবার আশা। এসএসসির ফরম পূরণসহ অন্যান্য প্রয়োজনে এনজিও থেকে ঋণ করতে হয়েছে। এখনো সেই কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে।
ধৃতী রানী কর্মকার বলে, ‘বাবার স্বপ্ন আমি ডাক্তার হব। সেটাই আমারও স্বপ্ন।’
মায়ের অনুপ্রেরণায় সারজিনের সংগ্রাম
একসময় সুখী পরিবার ছিল আরাফ সারজিনদের। কিন্তু মা-বাবার বিচ্ছেদ হলে নেমে আসে দুঃসময়। ক্যানসারে আক্রান্ত মায়ের সামান্য চাকরির আয়ে সংসার চলে টানাপোড়েনের মধ্যে। তবে মায়ের অনুপ্রেরণায় হাল না ছেড়ে পড়াশোনায় মন দেয় সে।
অভাব-অনটনের সঙ্গে লড়াই করেই অসাধারণ ফল করেছে রাজবাড়ীর আরাফ সারজিন। রাজবাড়ী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সে প্রতিটি বিষয়ে ৯০-এর ওপরে নম্বর পেয়ে জিপিএ-৫ অর্জন করেছে।
দুই ভাইবোনের মধ্যে সারজিন বড়। তাঁদের মা সেলিনা খাতুন উচ্চশিক্ষিত। ইসলামের ইতিহাসে এমএ পাস। ফরিদপুর শহরের সজ্জনকান্দা এলাকার ভাড়া বাসায় বসে তিনি বলেন, স্বামী তালাক দিলে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। স্বামীর অনুপস্থিতিতে আদালত ভরণপোষণের আদেশ দিলেও এখন পর্যন্ত কিনারা হয়নি। বাধ্য হয়ে ২০১৯ সালে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। এর মধ্যে তিনি ব্রেস্ট ক্যানসারে আক্রান্ত হন। চিকিৎসার ব্যয় সামলাতে গিয়ে সংসার ও সন্তানদের পড়াশোনা চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। এখন নিজের চিকিৎসার খরচ মেটাতে পারছেন না। সন্তানদের পড়াশোনা, সংসার চালাবেন কী করে?
সারজিনের স্বপ্ন চিকিৎসক হয়ে গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ানো। বাবা চলে যাওয়ার সময় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত সারজিন। সে বলে, ‘আমার মতো অনেক পরিবারের কষ্ট আছে। বড় হয়ে বাবাকে দেখাতে চাই, মানুষ হতে হয়।’
নানির স্বপ্নপূরণের পথে ওয়াহিদা
‘আমি দেখেছি অনেক গরিব মানুষ চিকিৎসার অভাবে কষ্ট পেয়ে মারা যায়। ডাক্তার হয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই।’ এভাবেই নিজের স্বপ্নের কথা বলছিল ফরিদপুরের খন্দকার ওয়াহিদা।
ওয়াহিদার নানি ফয়জুন্নেসা বেগম মেয়েকে চিকিৎসক বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মায়ের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। তাই নানির সেই অপূর্ণ স্বপ্নপূরণের দায় নিজের কাঁধে নিয়েছে ওয়াহিদা। ছোটবেলা থেকেই সে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে আসছে।
চলতি বছর ফরিদপুর সদরের গেরদা আবুল ফয়েজ মুজিবুর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে ওয়াহিদা। দুই বোনের মধ্যে সে ছোট। বাবা খন্দকার অহিদ সৌদি আরবে রোজগারের জন্য গিয়েছিলেন। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে দেশে ফিরে আসেন। তখন থেকেই পরিবারের আয়ে ভাটার টান নামে।
ওয়াহিদার মা বিলকিস বেগম বলেন, ‘মেয়েকে ডাক্তার করার স্বপ্ন দেখেছিলাম। এখন সংসারের টানাপোড়েনে কলেজে পড়ানোই কষ্টকর।’
মোহনার খরচ বহন করার কেউ নেই
জন্মের পর থেকে বাবাকে কখনো দেখেনি মোহনা আক্তার (অদিতি)। ছয় বছর বয়সে তার মা তাকে ফেলে আবার বিয়ে করেন। তার ঠাঁই হয় নানির কোলে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় নারীও মারা যান। এমন কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়েও মোহনা এবার যশোরের বর্ডার গার্ড স্কুলের মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। কিন্তু এখন তার উচ্চশিক্ষার খরচ বহন করার এখন আর কেউ নেই।
মোহনার নানাবাড়ি যশোর সদর উপজেলার খাজুরা গ্রামে। যশোর শহরের বকচর এলাকার নানা রবিউল ইসলামের ছোট একটি বাড়ি আছে। মোহনা এখন বকচারের এই বাড়িতে থাকে। আর দাদা বাড়ি ঝিনাইদহ জেলায়। যদিও তার কখনো যাওয়া হয়নি।
মোহনা জানায়, ‘বাবা মায়ের কাছ থেকে ভরণপোষণ বা আদর ভালোবাসা পাইনি। নানির কাছে আশ্রয় হয়েছিল। কিন্তু নানিও চার বছর আগে মারা গেছেন। এখন নানাই আমার লেখাপড়া খরচ দেন। স্কুলে কোচিং ফ্রি করে দিয়েছিলেন প্রধান শিক্ষক।’ আইন বিষয়ে পড়ে ব্যারিস্টার হওয়ার ইচ্ছা মোহনার।
বর্ডার গার্ড স্কুল যশোরের সিনিয়র শিক্ষক জেসমিন নাহার বলেন, ‘মোহনা অনেক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে এ পর্যন্ত এসেছে। চরম অনাদর অবহেলার মধ্য দিয়ে মেয়েটি লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে।’
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, ফরিদপুর, প্রতিনিধি, রাজবাড়ী, লালমনিরহাট ও যশোর অফিস]