কৃষকবন্ধু ‘কাশেম স্যার’

২০১৭ সাল থেকে কেঁচো সার নিয়ে কাজ করছেন আবুল কাশেম। তাঁর গবেষণাগার থেকে কেঁচো সার সংগ্রহ করে শতাধিক সহকর্মী ছাদবাগানে সবজিও ফলাচ্ছেন।

প্লাস্টিকের পাত্রে রাখা হয়েছে কেঁচো ও গোবর। গবেষণাগারে ওই কেঁচো ও গোবর পরীক্ষা করে দেখছেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. আবুল কাশেম। এ সময় সঙ্গে ছিলেন তাঁর সহকর্মীরা
ছবি: আনিস মাহমুদ

দীর্ঘদিন ধরে কেঁচো সারের গুণগত মানের উন্নয়ন ও কেঁচোর জীবনচক্র নিয়ে গবেষণা করছেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. আবুল কাশেম। এতে সফলতাও এসেছে। আন্তর্জাতিক একাধিক জার্নালে তাঁর এ–সংক্রান্ত গবেষণা প্রকাশিতও হয়। এ ছাড়া কেঁচো সার উৎপাদন ও ব্যবহারে কৃষকদের তিনি উৎসাহিত করছেন।

আবুল কাশেমের গবেষণাগার থেকে কেঁচো সার সংগ্রহ করে তাঁর শতাধিক সহকর্মী ছাদবাগানে সবজিও ফলাচ্ছেন। কৃষির উন্নয়নে নিবেদিতপ্রাণ এই শিক্ষক পরিচিতি পেয়েছেন কৃষক বন্ধু ‘কাশেম স্যার’ হিসেবে।

২০১৭ সাল থেকে কেঁচো সার নিয়ে কাজ করছেন আবুল কাশেম। তিনি বলেন, নব্বইয়ের দশক থেকে যশোর, রংপুরসহ কয়েকটি অঞ্চলে কেঁচো সারের ব্যবহার শুরু হয়। কিছু ব্যতিক্রম বাদে সিলেট অঞ্চলে এই সার ব্যবহারের প্রবণতা নেই বললেই চলে। বিষয়টি তিনি খেয়াল করেছেন। পরে কেঁচো সারের মানোন্নয়ন ও আধুনিকায়নে তিনি গবেষণা শুরু করেন। বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী ব্যবহার করে নানা প্রজাতির কেঁচো দিয়ে কেঁচো সারের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য তিনি গবেষণা করে সফলতা পান। তাঁর এ-সংক্রান্ত গবেষণা পাঁচটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়। আরও ছয় থেকে সাতটি গবেষণাপ্রবন্ধ শিগগির আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হবে। তিনি গবেষণায় কেঁচো সার ব্যবহার করে কীভাবে সবজির দেড় গুণ বা দ্বিগুণ ফলন বাড়ানো যায় এবং কম খরচে অধিক ফলন নিশ্চিত করা যায়, সেটি দেখিয়েছেন।

গবেষণার শুরুতে আবুল কাশেম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে একটি গবেষণাগার প্রস্তুত করেন। সেখানে তিনি কেঁচো সারের মান্নোনয়ন ও জীবনচক্র উন্মোচনে কাজ শুরু করেন। দুটি ক্ষেত্রেই তিনি শতভাগ সফল। তিনি কেঁচো সারের আরও মানোন্নয়নে গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন। তাঁর গবেষণাগারে প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৬৫ কেজি কেঁচো সার উৎপাদিতও হচ্ছে। এসব সার তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ২০ টাকা কেজি দরে কিনে ছাদবাগানে সবজির ফলনও করছেন।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে গবেষণার পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন কৃষকের জমিতেও কেঁচো সার ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রজাতির সবজির ফলন করে সাফল্য পাচ্ছেন আবুল কাশেম। তিনি বলেন, ২০১৯ সাল থেকে কৃষক পর্যায়ে তাঁর গবেষণা ছড়িয়ে দিতে কাজ শুরু করেন। এরই অংশ হিসেবে বিভিন্ন কৃষকের জমিতে কেঁচো সারের ব্যবহারে সবজির চাষাবাদ শুরু হয়। সুনামগঞ্জের সদর উপজেলার বাহাদুরপুর ও নীলগঞ্জ গ্রামে দুই বিঘা এবং শান্তিগঞ্জ উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে এক বিঘা জমিতে ফুলকপি, বাঁধাকপি, লালশাক, টমেটো, আলু, বেগুন, লাউ, শসা, মরিচসহ বিভিন্ন প্রজাতির সবজি চাষাবাদ করা হয়। এ সার ব্যবহারে কৃষকদের সার কেনায় অনেক টাকা বেঁচে গেছে। এ ছাড়া একটি গাছ মাটি থেকে যে ১৪টি উপাদান সংগ্রহ করে থাকে, এর সব কটিই কেঁচো সারে আছে। তাই সুনামগঞ্জের মাঠপর্যায়ে উৎপাদিত সবজির বাগানে ফলন দেড় গুণ ও দ্বিগুণ হয়েছে। এ ছাড়া মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি মাটির দূষণ কমাতেও এ সার কার্যকর। এ সার ব্যবহারে মাটিও উন্নত হয়।

আবুল কাশেম বলেন, সিলেট অঞ্চলে সাধারণত পেঁপে বাঁকা, জাম্বুরা ছোট আকারের ও ফুলকপির মাঝখানে ফাঁপা হয়। তবে কেঁচো সার ব্যবহার করলে এসব হবে না। এ ছাড়া রোগ দমন ও পোকামাকড়ের উপদ্রব থেকেও রেহাই পাওয়া যায়। এর সার জমিতে রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীবের সংখ্যা কমিয়ে পরিবেশগত সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে।

কেঁচোর জীবনচক্র পরিমাপ

আবুল কাশেমের কেঁচো সার নিয়ে গবেষণালব্ধ প্রবন্ধগুলো যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাগ্রিকালচার রিসার্স, ইউরোপের ইউরেশিয়ান জার্নাল অব সয়েল সায়েন্স, অর্গানিক অ্যাগ্রিকালচার এবং ভারতের জার্নাল অব অ্যাগ্রিকালচার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ফুড টেকনোলজি-তে প্রকাশিত হয়েছে। এর বাইরে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় জার্নালে এ-সংক্রান্ত তাঁর একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এসব প্রবন্ধে তিনি কেঁচোর ডিম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়সীমা, স্বাস্থ্যগত অবস্থা, প্রজননের উপযুক্ত সময় আর জীবনচক্র পরিমাপ করেছেন।

আবুল কাশেম বলেন, ‘আমরা আগে জানতাম একটি কেঁচো সাধারণত একটি ডিমই দিয়ে থাকে। পরে গবেষণা করে বের করলাম, আসলে একটি কেঁচোর ডিম থেকে দুটো বা তিনটা বাচ্চা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী ও উচ্ছিষ্ট অথবা মুরগির বিষ্ঠা আর কেঁচো দিয়ে বা গোবর আর কেঁচো দিয়ে কেঁচো সার প্রস্তুতে কীভাবে মান আরও বাড়ানো যায়, সেসবই গবেষণা প্রবন্ধগুলোতে সবিস্তার ব্যাখ্যা করা হয়। এভাবে কেঁচো সার তৈরি করে একজন কৃষক কম খরচে অতি সহজেই সবজির ফলন দ্বিগুণ করতে পারবেন।’ তিনি বলেন, কেঁচো সার মূলত জৈব সার। মূলত এক মাসের বাসি গোবর বা তরি–তরকারির ফেলে দেওয়া অংশ, ফলমূলের খোসা, উদ্ভিদের লতাপাতা, পশুপাখির নাড়িভুঁড়ি, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, ছোট ছোট করে কাটা খড়কুটো খেয়ে কেঁচো মল ত্যাগ করে এবং এর সঙ্গে কেঁচোর দেহ থেকে একধরনের রাসায়নিক পদার্থ বের হয়ে যে সার তৈরি হয়, তাকেই কেঁচো সার বলে। এটি পরিবেশবান্ধব। সিলেট অঞ্চলের কোন খাবারের সঙ্গে কেঁচো দিয়ে সার উৎপাদন করলে ভালো মানের কেঁচো সার তৈরি করা সম্ভব, সেটিও গবেষণায় তিনি বের করেছেন।

আবুল কাশেম বলেন, তিনি সাধারণত বাসি গোবর দিয়ে কেঁচো সার তৈরি করেন। ১০০ কেজি গোবর ব্যবহার করে ৫০ থেকে ৬৫ কেজি কেঁচো সার উৎপাদন করা সম্ভব। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীরা এসব সার কিনে ছাদবাগানে সবজি উৎপাদনে ব্যবহার করছেন। তবে কৃষক পর্যায়ে এ সার উৎপাদন করলে উৎপাদনমূল্য আরও কম পড়বে।

কেঁচো সার প্রস্তুতের মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষজন কম পুঁজি ও স্বল্প পরিশ্রমে বিকল্প ব্যবসায়িক কাজও শুরু করতে পারেন বলে মন্তব্য করেছেন আবুল কাশেম। তিনি বলেন, গ্রামীণ নারীরা সংসারের অন্যান্য কাজের পাশাপাশি ব্যবসাটি পরিচালনা করতে পারবেন। কেঁচো সার প্রস্তুত করা নিম্নমধ্যবিত্তদের একটি উপকারী কুটিরশিল্প এবং পরিপূরক আয়ের উৎস। যেহেতু দিন দিন ফুল ও শাকসবজি চাষ বেড়ে চলেছে, তাই কেঁচো সারের চাহিদাও বাড়বে। ফুল চাষে এ সারের বিকল্প নেই। 

আবুল কাশেম বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০০ সালে ‘ফসলবিন্যাসের সঙ্গে মাটির জৈব পদার্থ এবং ধানের উৎপাদনশীলনতা’ বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ৩৭ বছর গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে ২০১৩ সালে তিনি সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। 

কৃষক বন্ধু ‘কাশেম স্যার’

২০১৭ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা গবেষণাক্ষেত্র তৈরি করে ছোট-বড় পাত্রে কেঁচো সার প্রস্তুত করে সারের মান উন্নয়নে গবেষণাকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন আবুল কাশেম। তবে ২০১৯ সাল থেকে তিনি মাঠপর্যায়ে তাঁর গবেষণালব্ধ ফলাফল বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেন।

আবুল কাশেমের বলে দেওয়া পদ্ধতিতে কেঁচো সার ব্যবহার করে সাফল্য পাওয়া কৃষকেরা বলছেন, কেঁচো সার ব্যবহার করে তাঁরা এখন সবজি চাষে দ্বিগুণ সাফল্য পাচ্ছেন। সাফল্য পাওয়া কৃষকদের কাছে আবুল কাশেম ‘কৃষক বন্ধু কাশেম স্যার’ নামেই পরিচিত।

আবুল কাশেমের মতে, সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় উঁচু মাটি সাধারণত অম্লীয় বৈশিষ্ট্যের হয়। ফলে এ মাটিতে গাছের প্রয়োজনীয় গৌণ খাদ্য উপাদানের পরিমাণ কম থাকে। এতে কৃষকেরা কাঙ্ক্ষিত ফলন পান না। বাজারে যেসব সার রয়েছে, এসব সারে একটি বা দুটি উপাদান থাকে। তবে কেঁচো সারে ফসল উৎপাদনের প্রয়োজনীয় সব মুখ্য ও গৌণ খাদ্য উপাদান উপস্থিত থাকে। তাই বর্ধিত সবজি উৎপাদনে এ সার ব্যবহার করলে কৃষকেরা লাভবান হবেন।

আবুল কাশেম বলেন, ‘সরকার চাইলে কেঁচো সারের ব্যবহার বাড়াতে নানামুখী প্রচারণামূলক উদ্যোগ নিতে পারে। এতে কম খরচে কৃষকেরা অধিক ফলন পাবেন। এ ক্ষেত্রে যদি আমাকে সিলেট অঞ্চলের মাঠপর্যায়ে পরামর্শদাতা হিসেবে নিযুক্ত করা হয়, তাহলে বিনা পয়সায় এ কাজ করতে রাজি আছি। কোন পদ্ধতিতে সার উৎপাদন করলে ফসলের ফলন বাড়ানো সম্ভব, সেটা আমি হাতে–কলমে কৃষকদের শিখিয়ে দিতেও আগ্রহী।’