ভরা মৌসুমেও পানি তলানিতে

কুমার নদ ও নবগঙ্গা নদী চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গা নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে মাগুরা শহর অংশে মিলে নবগঙ্গা নাম ধারণ করে নড়াইলে চলে গেছে।

মাগুরা শহরে কুমার নদে মিলিত হওয়ার আগে নবগঙ্গা নদী সরু খালে পরিণত হয়েছে। মাগুরা শহরের নতুন বাজার এলাকায় গতকালপ্রথম আলো

মাগুরা শহরঘেঁষা কুমার নদ ও নবগঙ্গা নদীর স্মৃতি এখনো তাড়িত করে মাগুরা পৌরসভার সাবেক মেয়র আবদুল গফুরকে (৭৪)। তাঁর বাড়ি নবগঙ্গাঘেঁষা পারনান্দুয়ালী গ্রামে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে গতকাল শনিবার কথা হয় তাঁর সঙ্গে। নদীর করুণ অবস্থা ও ভরা মৌসুমে নদীতে পর্যাপ্ত পানি না থাকার বিষয়টি জানান তিনি।

আবদুল গফুর বললেন, ‘যখন ছোট ছিলাম, তখন মাগুরা শহরের জেটিসি ঘাটে লঞ্চ ভিড়ত। ছোট–বড় স্টিমারও আসত। এই কুমার-নবগঙ্গা দিয়ে নৌপথে খুলনার সঙ্গে ভালো যোগাযোগ ছিল। তবে এ কথা এখন আর কেউ বিশ্বাস করবে না। কারণ, এই নদী আর সেই নদী নেই।’

সাবেক এই মেয়র আরও বলেন, যুদ্ধের আগে জি কে (গঙ্গা-কপোতাক্ষ) সেচ প্রকল্প করার সময় পদ্মার সঙ্গে সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ার পর নদীতে প্রবাহ কমতে থাকে। এখন বৃষ্টি ছাড়া নদীতে পানি আসে না। দেড় দশক আগেও পবর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি ভরে যেত। এখন ভরা মৌসুমেও পানি তলানিতে থাকে।

* কুমার নদ ও নবগঙ্গা নদী চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গা নদী থেকে উৎপন্ন হয়। * মাগুরা থেকে নড়াইলের বড়দিয়ায় মধুমতী মেশার আগে নবগঙ্গার প্রস্থ বেড়েছে।

মাগুরা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, কুমার ও নবগঙ্গা দুটোই চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গা নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে মাগুরা শহর অংশে মিলিত হয়ে নবগঙ্গা নাম ধারণ করে নড়াইলে চলে গেছে। এর মধ্যে ১২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ কুমার নদ চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা মাথাভাঙ্গা নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ হয়ে মাগুরা শহরে এসে নবগঙ্গা নদীতে পতিত হয়েছে। একসময় এটি পদ্মার শাখা নদী ছিল। এদিকে চুয়াডাঙ্গা সদরে মাথাভাঙ্গা নদী থেকে উৎপন্ন নবগঙ্গা ঝিনাইদহ সদর উপজেলার মধ্য দিয়ে মাগুরা সদর উপজেলায় প্রবেশ করেছে। ২১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটির মাগুরা শহরে কুমার নদে মিলিত হওয়ার আগপর্যন্ত একেবারে নালায় পরিণত হয়েছে। মাগুরা থেকে নড়াইলের বড়দিয়ায় মধুমতী মেশার আগে নবগঙ্গার গড় প্রস্থ ক্রমেই বেড়েছে।

পাউবোর তথ্য অনুসারে, মাগুরা অংশে শুষ্ক মৌসুমে (ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল) নবগঙ্গা নদীর গড় প্রবাহ থাকে ১৭ ঘন মিটার। আর গভীরতা ৩ ঘন মিটার। অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে (আগস্ট) নদীর গড় প্রবাহ দাঁড়ায় ১৭০ ঘন মিটার পর্যন্ত। এ সময় নদীর গভীরতা থাকে ১০ ঘনমিটার।

মাগুরা পৌরসভার পারনান্দুয়ালী গ্রামের বাসিন্দা আবদুল্লাহ আল মামুন (৬৪) প্রথম আলোকে বলেন, পানিই নদীর প্রাণ। ধরতে গেলে বছরের ১১ মাস এ নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী থাকে। একে তো প্রবাহ নেই, অল্প পানি; তারপর শহরের ড্রেন, সুয়ারেজ লাইন, বাজারের ময়লা–আবর্জনা ফেলা হয় এই নদীতে। গোসল করার উপায়ও নেই।

আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন মাগুরা শহরের জেটিসি ঘাটে লঞ্চ ভিড়ত। ছোট–বড় স্টিমারও আসত।
আবদুল গফুর, মাগুরা পৌরসভার সাবেক মেয়র

সারা বছর নদীকে জলাধার হিসেবে ব্যবহার করার লক্ষ্যে ২০১৯ সালে প্রায় ৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে মাগুরায় নবগঙ্গা নদী পুনঃখননের একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। ওই প্রকল্পের আওতায় শহরের পূর্বাশা ঘাট থেকে আলোকদিয়া সেতু পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার পুনঃখনন করা হয়। তবে প্রকল্পের কোনো সুফল পাওয়া যায়নি বলে দাবি এলাকাবাসীর। তাঁরা বলছেন, নদীর গড় প্রস্থ যেখানে ৩০০ মিটার, সেখানে খনন হয়েছে ৮০ মিটার। তারপর খননের মাটি ফেলা হয়েছে নদীর মাঝেই। ফলে নদীর মাঝে মাটির ঢিবি তৈরি হয়েছিল, যা বর্ষা মৌসুমে আবার ধুয়ে নদীতেই গেছে। এ কারণে প্রকল্পের দৃশ্যমান কোনো সুফল পাননি স্থানীয়ম লোকজন।

স্থানীয় বাসিন্দা ও পাউবোর কর্মকর্তারা জানান, গত শতকের ষাটের দশকে গঙ্গা–কপোতাক্ষ (জি কে) সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কুষ্টিয়ায় গড়াইয়ের শাখা কালী ও ডাকুয়া নদীর উৎসমুখে বাঁধ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই থেকে নদী দুটি মারা গেছে। নদী দুটির মাধ্যমে কুমার প্রবাহ পেত। বর্তমানে কুমার ও নবগঙ্গা দুটি নদীরই উৎসমুখে মাথাভাঙ্গা নদীতে স্লুইসগেট দিয়ে বন্ধ করা। ফলে বর্ষা মৌসুমে খাল-বিল বৃষ্টির পানি এবং শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা থেকে চুইয়ে আসা পানিই কুমার নবগঙ্গার একমাত্র উৎস।

জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েক দশক আগে নদীতে দেশীয় প্রায় সব প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। এখন দিনে দিনে মাছের পরিমাণ ক্রমেই কমে আসছে। যার প্রভাব পড়েছে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা মানুষের ওপর। এমনই একজন বরুনাতৈল গ্রামের মো. রতন মোল্লা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগে অনেক ধরনের মাছ পাওয়া যেত। এখন শৈল, গজার, টাকি ছাড়া মাছই পাওয়া যায় না। নদী খালের মতো হয়ে গেছে। নদীতে পানি না থাকলে মাছ কীভাবে থাকবে? এখন বছরে ছয় মাস নদীতে মাছ পাওয়া যায়। বাকি সময় অন্য কিছু করতে হয়।

যশোর পাউবোর পানিবিজ্ঞান উপবিভাগের প্রকৌশলী মো. রেজাউল ইসলাম বলেন, কিছু পেতে হলে যেমন কিছু হারাতে হয়, ঠিক তেমনই জি কে সেচ প্রকল্পের কারণে কৃষি উৎপাদন বেড়েছে ঠিকই, তবে স্থায়ী কিছু ক্ষতিও হয়েছে। কুমার–নবগঙ্গায় আগে পদ্মার প্রবাহ আসত। বন্যার পানির সঙ্গে পলি আসত। সেই পলি না আসার কারণে জমির উর্বরতা কমছে। সারের ব্যবহার বেশি হচ্ছে। এই একই কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, যে কারণে শুষ্ক মৌসুমে অনেক এলাকায় নলকূপে পানি পাওয়া যায় না।