রাজশাহী সিটিতে সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে লড়বেন হিজড়া সুলতানা

জনগণের সেবা করতে চান সুলতানা আহমেদ

হিজড়া বলে নবম শ্রেণিতে ওঠার পর আর বিদ্যালয়ে টিকতে পারেননি সুলতানা আহমেদ ওরফে সাগরিকা। আগের ক্লাসগুলোও পার করেছেন নানা টিপ্পনীতে। শেষমেশ বাড়িও ছাড়তে হয়। এরপর নানা সংগ্রামে কেটেছে জীবন। সব বাধা পেরিয়ে এখন জনগণের সেবা করতে চান সুলতানা আহমেদ। সবার কাছে সাগরিকা নামেই পরিচিত তিনি।

সুলতানা এবার রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করতে যাচ্ছেন। সিটি করপোরেশনের ১৯, ২০ ও ২১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী হচ্ছেন তিনি।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে আগামী ২১ জুন। ২৩ মে পর্যন্ত মনোনয়নপত্র দাখিল করা যাবে। ইতিমধ্যে ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রার্থীরা কুশল বিনিময় করেছেন। সুলতানাও ভোটারদের কাছে গিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন।

এই পর্যন্ত আসার পথটা মোটেও সহজ ছিল না উল্লেখ করে সুলতানা আহমেদ বলেন, ছোটবেলা থেকে তাঁর শারীরিক পরিবর্তন শুরু হয়। তখন থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পরিবারের সদস্যরা তাঁকে সহ্য করতে পারছিলেন না। নবম শ্রেণিতে ওঠার পর বাধ্য হয়ে বিদ্যালয় ও বাড়ি ছেড়ে গুরুমায়ের কাছে চলে আসেন।

সাগরিকার বাড়ি রাজশাহী নগরের শাহমখদুম থানাধীন শিল্পীপাড়া এলাকায়। বাবা-মায়ের চার সন্তানের একজন তিনি। বাবা মারা গেছেন। বর্তমানে মা-বোনের কাছে থাকেন। তিনি মাঝেমধ্যে বাড়িতে যান। মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করছেন সুলতানা।

গুরুমায়ের কাছে আসার পর থেকে অন্য হিজড়াদের সঙ্গে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নবজাতককে আশীর্বাদ করা ও দোকান থেকে সাহায্য সংগ্রহের কাজ করেন সুলতানা। জীবনে সইতে হয়েছে নানা নির্যাতন ও কটু কথা।

২০০০ সালে ‘দিনের আলো হিজড়া সংঘ’ নামের সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়। ২০০৫ সালে মহিলা অধিদপ্তর ও ২০০৭ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন পায় সংগঠনটি। তখন থেকে তিনি বিভিন্ন অলাভজনক সংস্থায় চাকরি করেছেন। বর্তমানে ‘দিনের আলো হিজড়া সংঘ’-এর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

এইচআইভির ওপর সচেতন করা, পরিবার পরিকল্পনা, মানবাধিকার ও অধিকার নিয়ে কাজ করেছেন জানিয়ে সুলতানা আহমেদ বলেন, হিজড়াদের আগের কাজবাজ থেকে বের করার চেষ্টা করছেন। এখন হিজড়ারা নিজেরা কিছু করার কথা ভাবছেন। তিনি নিজেও কাজ করছেন। হিজড়াদের ভোটাধিকার, বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশীদারত্ব নিয়েও কাজ করেছেন।

২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত একটি প্রকল্পে কাজ করতেন সুলতানা। তখন থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি নিজেও একবার একটা কাজে গিয়ে পাননি। তখন থেকে ইচ্ছা জাগে, জনগণের জন্য কাজ করবেন। জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের সম্প্রদায়ের মানুষের কথা বলেন না। এ জন্য মূলত একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরির জন্য কাজ করছেন। যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি জনসাধারণের ও তাঁর সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকারের কথা বলতে পারবেন।

সুলতানা মাঠপর্যায়ে প্রতিদিনই মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন নানা বিষয়ে। বলেন, মানুষ ভিন্ন ধরনের নেতৃত্ব চায়। হিজড়াদের যোগাযোগ ক্ষমতা অন্যদের চেয়ে বেশি। নারী কাউন্সিলররা রাত-বিরাতে চলতে পারেন না। পুরুষেরাও নারীদের নিয়ে কাজ করতে পারেন না। কিন্তু হিজড়াদের বেড়ে ওঠাটাই অন্যদের থেকে আলাদা। তাঁরা যেকোনো সময় মানুষের বিপদ-আপদে দাঁড়াতে পারেন।

ভোটের মাঠে চ্যালেঞ্জও রয়েছে সুলতানার। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা নানা কথা ছড়াচ্ছেন। তিনি বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বীদের পক্ষ থেকে ছড়ানো হচ্ছে যে হিজড়া জনপ্রতিনিধি হলে অত্যাচার বেড়ে যাবে। হিজড়াদের সম্পর্কে আগে যে ধ্যানধারণা ছিল, তা সামনে আনার চেষ্টা করছেন তাঁরা। তবে জনগণ তাঁদেরও ভালোবাসতে শিখে গেছে। অনেক জায়গায় তাঁদের সম্প্রদায়ের জনপ্রতিনিধিরা ভালো করছেন। তিনিও সব বাধা উতরে যাবেন।

দিনের আলো হিজড়া সংঘের সভাপতি মোহনা বলেন, তাঁরা মানুষের কাছে যাচ্ছেন। মানুষ সুলতানার প্রার্থী হওয়াটাকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ আসছে। সেগুলো মোকাবিলায় তাঁরা প্রস্তুত আছেন।