‘দুইবার পেশা বদলাইয়া ভ্যানগাড়ি ধরছি, তবু অভাব গেল না’
‘ছোটকালে বাবা মইরা গেছেন। তহন থেইক্কা সংসারের হাল ধরছি। ২৫ বছর টুকটাক কৃষিকাজ করছি। পরে ২০ বছর করছি দিনমজুরের কাজ। এই কামে আয়–রোজগার তেমন অইত না। দুইবার পেশা বদলাইয়া পরে ভ্যানগাড়ি ধরছি। তবু সংসারের অভাব গেল না। অসুস্থ শরীর নিয়াই ১০ বছর ধইরা ভ্যানগাড়িতে মাল টানতাছি। এতে যা পাই, তা দিয়া সংসার চলে না। কত মানুষের ভাগ্য বদলাইল; কিন্তু আমার ভাগ্যের চাকা ঘুরল না।’
এই খেদ ও কষ্টের কথা ভ্যানচালক লিয়াকত আলী সর্দারের (৭০)। তাঁর বাড়ি চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার উত্তর নলুয়া গ্রামে। ওই গ্রামের মৃত মো. খলিল সর্দারের ছেলে তিনি। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে লিয়াকত মেজ। এখন তিন ছেলে, দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর সংসার। তিনি উপজেলা সদর ও আশপাশের এলাকায় ভ্যানগাড়ি চালিয়ে ভাড়ায় মালামাল আনা-নেওয়া করে জীবিকা চালাচ্ছেন।
গত মঙ্গলবার সকালে উপজেলা সদরের টিঅ্যান্ডটি এলাকায় এক ব্যক্তির মালামাল ভ্যানে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন লিয়াকত। সেখানে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। আলাপচারিতায় উঠে আসে তাঁর জীবনের নানা কথা, শারীরিক অসুস্থতা, দুঃখগাথা, আর্থিক সমস্যা ও পেশাগত ঝুঁকির কথা। লিয়াকত জানান, খুব ছোটকালে তাঁর বাবা মারা যান। পৈতৃক জমিজমা নেই। সংসারের দায়িত্ব তাঁর ওপর বর্তায়। ২৫ বছর টুকটাক কৃষিকাজ করতেন, যা আয় হতো তা দিয়ে কোনোরকমে সংসার চালাতেন। চার বোনকেও বিয়ে দেন। পরে ওই কাজ ছেড়ে কয়েক বছর দিনমজুরের কাজ করেছেন। এতে রোজগার তেমন না হওয়ায় সেটিও ছেড়ে ভ্যানগাড়ি ধরেন।
১০ বছর ধরে ভ্যানগাড়ি চালিয়ে ভাড়ায় অন্যের মালামাল টানেন লিয়াকত। প্রতিদিন উপার্জন হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। হাঁটুতে বাতজনিত ব্যথা থাকায় প্রায়ই কাজ করেত পারেন না। শরীরে ব্যথানাশক ইনজেকশন নিয়ে মাঝেমধ্যে মাল টানেন। প্রতি মাসে আয় করেন ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। এ টাকায় স্ত্রী, তিন ছেলে ও দুই মেয়ের ভরণ-পোষণ এবং ওষুধপথ্য কেনাসহ সব কিছু করতে হয়। বোনদেরও দেখভাল করতে হয়। এত অল্প টাকায় সংসার ঠিকমতো চলে না। খেয়ে, না খেয়ে গাড়ি টানতে হয়। দুইবার পেশা বদল করেও সংসারের অভাব ঘুচল না। যে পরিবারের জন্য এত কষ্ট করছেন, তাঁরাও তাঁর দুঃখকষ্ট বুঝল না। শারীরিক দুর্বলতা ও অসুস্থতা সত্ত্বেও প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে মালামাল টানছেন।
‘মালামাল না টানলে খামু কী, সংসার চলব ক্যামনে। এলিগা অসুস্থ শরীর নিয়াই মালামাল টানি। ভ্যানের তিন চাকায়ই আমার সবকিছু, আমার ভাগ্য। প্রায় ৬০ বছর ধইরা কাম করতাছি, তবু ভাগ্যের চাকা ঘুরল না। তাতেও কষ্ট নাই। গতর খাইট্টা, খাইয়া-পইরা বাঁইচা আছি এইডাই বড় কথা। বিড়বিড় করে কথাগুলো বললেন লিয়াকত।
উপজেলার কলাদী এলাকার স্কুলশিক্ষক সোহেল আহম্মেদ বলেন, তিনি ভ্যানচালক লিয়াকতকে চেনেন। মাঝেমধ্যে তাঁর বাসার মালামাল আনা-নেওয়া করেন। ন্যায্যভাড়া ছাড়া এক টাকাও বেশি নেন না। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি যেভাবে বাঁচার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, তা তাঁর লড়াকু মানসিকতার পরিচায়ক। তিনি শ্রমজীবী মানুষের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।